রাজু কী করবে বুঝতে না পেরে মেয়েটার হাত ছুঁয়ে বলল, “আমি তোমাকে সাহায্য করব।”
এই প্রথমবার মেয়েটা একটু হাসল, এত সুন্দর মেয়েটা হাসলে আরও অনেক সুন্দর লাগার কথা, কিন্তু মেয়েটির হাসিটি ঠিক স্বাভাবিক ছিল না। হঠাৎ করে রাজুর কেন জানি ভয় করতে থাকে। মেয়েটা তার মুখে হাসিটা ধরে রেখে বলল, “তুমি আমাকে একটা ব্লেড কিনে এনে দেবে?”
“ব্লেড!” রাজু হতবাক হয়ে আবার জিজ্ঞেস করল, “ব্লেড?”
“হ্যাঁ, আমার কাছে কোনো পয়সা নেই, থাকলে তোমাকে দিতাম। তুমি নিজের পয়সা দিয়ে কিনে আনবে। ঠিক আছে?”
রাজু কয়েক মুহূর্তে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থেকে ভয়ে ভয়ে বলল, “তুমি ব্লেড দিয়ে কী করবে?”
মেয়েটা তার হাতের কবজির কাছের অংশটায় আরেক হাত দিয়ে পোঁচ দেওয়ার মতো করে দেখিয়ে বলল, “এইখানে যে-রগটা আছে সেটা কেটে ফেলব।”
এত সহজ স্বরে কেউ যে-রকম একটা কথা বলতে পারে নিজের কানে না শুনলে রাজু কখনও বিশ্বাস করত না। সে হঠাৎ করে শিউরে ওটে, একধরনের আতঙ্ক এসে তার উপর ভর করে। সে মেয়েটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, তখনও সে কথাটা বিশ্বাস করতে পারছে না। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, “তুমি এরকম বলছ কেন?”
মেয়েটা কোনো কথা না বলে আবার হাসল, আর সে-হাসি দেখে রাজু আবার শিউরে উঠল, কোনোমতে বলল, “তুমি বলো তোমার কী হয়েছে, তোমার কী বিপদ? আমরা তোমাকে সাহায্য করব।”
মেয়েটা মাথা নাড়ল, “আমাকে কেউ সাহায্য করতে পারবে না। কেউ না।”
“কেন এরকম বলছ? তোমাকে কে আটকে রেখেছে? তুমি আমাকে বলল আমি পুলিশকে গিয়ে বলব।”
“পুলিশকে বলবে?”
“হ্যাঁ। পুলিশ যদি আমার কথা বিশ্বাস না করে আমি বড় একজন মানুষকে নিয়ে যাব, পুলিশ তখন বিশ্বাস করবে। কে তোমাকে এখানে আটকে রেখেছে?”
মেয়েটা কোনো কথা না বলে বিচিত্র একটা দৃষ্টিতে রাজুর দিকে তাকিয়ে রইল। রাগ অভিমান দুঃখ হতাশা সবকিছু মিলিয়ে সেটি ভয়ংকর একধরনের দৃষ্টি। রাজু আবার জিজ্ঞেস করল, “কে?”
মেয়েটা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমার বাবা।”
রাজু বিস্ফারিত চোখে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার বাবা?”
“হ্যাঁ।”
“তোমার নিজের বাবা?”
মেয়েটা মাথা নাড়ল। রাজু খানিকক্ষণ হতবুদ্ধির মতো মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকে। সে কিছুই বুঝতে পারল না–একজন বাবা তার মেয়েকে কেন ধসে যাওয়া একটা বাড়িতে তালা মেরে বন্ধ করে রাখবে! সে মাথা নেড়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমার বাবা কেন তোমাকে আটকে রেখেছে? তোমার মা কোথায়? তোমার মা কেন কিছু বলে না?”
“আমার মা জানে না আমি কোথায়। বাবা আমাকে লুকিয়ে নিয়ে এসেছে। জোর করে লুকিয়ে নিয়ে এসেছে। মেয়েটা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমার মা নিশ্চয়ই এতদিনে পাগল হয়ে গেছে।”
“তোমার বাবা কেন তোমাকে ধরে এনেছে?”
“আমার দাদা ছিল বড় রাজাকার। আমার বাবাও সেরকম। আবার বাবা মনে করে মেয়েদের সবসময় ঘরের ভিতরে থাকতে হয়। তাদের পড়াশোনা করতে হয় না। তাদের যদি বাইরে বের হতে হয়, তা হলে বোরখা পরে মুখ ঢেকে বাইরে যেতে হয়, নাহয় সেইসব মেয়ে দোজখে যায়। আবার বাবা আমাকে মনে হয় খুব ভালোবাসে–একেবারে চায় না আমি দোজখে যাই।”
মেয়েটা হঠাৎ শব্দ করে হেসে ফেলল। রাজু অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকে, সে কি সত্যিই বলছে, নাকি ঠাট্টা করছে?
“আমার বাবা আমার মাকে দুচোখে দেখতে পারে না। মাকে এত ঘেন্না করে যে তুমি চিন্তাও করতে পারবে না। তাই বাবা ঠিক করেছে আমার মাকে শাস্তি দেবে এত কঠিন শাস্তি যেন মা জীবনেও সেই শাস্তির কথা ভুলতে না পারে।”
“কী শাস্তি? তোমাকে মেরে ফেলবে?”
“ধুর! সেটা কি বড় শাস্তি হল?”
“তা হলে?”
“আমার বাবা আমার জন্য বিয়ে ঠিক করেছে। এইখানে কোনো গ্রামে থাকে অনেক বড় মোল্লা। আগের কয়েকটি বউ আছে। তার সাথে আমার বিয়ে দেবে–”
“বিয়ে! তোমার! তোমার?” মেয়েটা মাথা নাড়ল। রাজু হতভম্বের মতো বলল, “তুমি তো এত ছোট!”
“যত ছোট হয় তত ভালো। তা হলে তাদের মনটাকে তাদের জামাইরা যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে বদলে দিতে পারে। এই মোল্লার বাড়িতে খুব কঠিন পর্দা, আমি কোনোদিন সেখান থেকে বের হতে পারব না। আমার মা কোনোদিন জানতেও পারবে না আমি কোথায়। আমাকে খুঁজে খুঁজে পাগল হয়ে যাবে, আর আমার বাবা খুশিতে হা হা করে হাসবে।” মেয়েটা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আমার বাবা আসলে একটা পিশাচ। আমার দাদাও পিশাচ ছিল, “আমার বাবাও পিশাচ। আমরা পিশাচের বংশ।”
রাজু ছটফট করে উঠে বলল, “কিন্তু পুলিশকে বললে পুলিশ এসে তোমাকে উদ্ধার করবে। তোমার মতো ছোট একটা মেয়েকে জোর করে বিয়ে দিতে পারবে না। কোনোদিনও পারবে না।”
“তোমাকে বলেছি না আমার দাদা যেরকম রাজাকার ছিল আমার বাবাও সেরকম রাজাকার? মিডল ইস্ট থেকে বাবার কাছে বস্তা বস্তা টাকা আসে আর আমার বাবা সেই টাকা থেকে বস্তা বস্তা টাকা পুলিশকে দেয়। পুলিশ কখনও বাবাকে কিছু করবে না। কোনো বাবা যদি নিজের মেয়েকে তার সাথে রাখে সেটা কি দোষের কিছু?”
রাজু কী বলবে বুঝতে পারল না। কিছু-একটা বলতে গিয়ে আবার সে থেমে গেল।
মেয়েটা রাজুর চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে নরম গলায় বলল, “কয়দিন থেকে আমার খুব মন-খারাপ ছিল। আজকে সকালে আমার হাত থেকে একটা গ্লাস পড়ে ভেঙে গেল, ভাঙা কাঁচ দেখে আমার হঠাৎ মনে হল, আরে, আমি কেন মন-খারাপ করছি! কাঁচ দিয়ে ঘ্যাঁচ করে হাতের একটা রগ কেটে দেব। কাত করে রাখলে কালির বোতল থেকে যেরকম সব কালি বের হয়ে যায় সেরকম আমার শরীরের সব রক্ত বের হয়ে যাবে। আমার বাবা তার জামাইকে নিয়ে এসে দেখবে তার মেয়ে মরে পড়ে আছে। ভেবেছিল মেয়েকে জোর করে বেহেশতে পাঠাবে, কিন্তু পারবে না, দেখবে মেয়ে দোজখে চলে গেছে। তুমি জান কেউ আত্মহত্যা করলে সে দোজখে যায়?”