সাগর বলল, “আমি যাব, ঠিক আছে?”
রাজু মাথা নাড়ল, “না সাগর, তুই বেশি ছোট। গিয়ে ঠিক করে কথা বলতে পারবি না।”
“কে বলেছে পারব না?” সাগর রেগে উঠে বলল, “একশোবার পারব!”
“ঠিক আছে, পারবি। কিন্তু তুই তো ছোট, মেয়েটা মনে করবে তোর সাথে কথা বলে কোনো লাভ নেই। ছোটদের কেউ বেশি পাত্তা দেয় না। ভিতরে গেলে যাব আমি নাহয় আগুনালি।”
আগুনালি বলল, “তুমিই যাও–আমি মেয়েদের সাথে ভালো করে কথা বলতে পারি না।”
রাজু একটু অবাক হয়ে আগুনালির দিকে তাকাল, কী একটা বলতে গিয়ে থেমে গিয়ে বলল, “ঠিক আছে, আমিই যাব। তাড়াতাড়ি চলো।”
রাজু আগুনালি আর সাগরকে বাসার কাছাকাছি দাঁড় করিয়ে রেখে বলল, হঠাৎ করে যদি দারোয়ানটা এসে যায় তা হলে যেন তাকে সাবধান করে দেয়। দারোয়ানটার মনে সন্দেহ না জাগিয়ে কেমন করে সাবধান করা যায় সেটা নিয়ে খানিকক্ষণ আলোচনা করে ঠিক করা হল, আগুনালি কোনো কথা না বলে মুখে আঙুল দিয়ে শিষ দেবে–দারোয়ানটা অনেক দূরে থাকতেই যদি শিষ দেওয়া হয় সে হয়তো সন্দেহ করবে না। অনেক দূরে থাকতেই তাকে দেখার জন্যে সাগর রাস্তার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল, দূর থেকে দারোয়ানটা দেখে ফেললে সাগর ছুটে এসে আগুনালিকে বলবে, আগুনালি তখন রাজুকে বিপদ-সংকেত দেবে।
মোটামুটি সব প্রস্তুতি নিয়ে রাজু সাবধানে নাহার মঞ্জিলে ঢোকে। বাইরে দরজা নেই, একসময়ে ছিল, পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। ভিতরে নানারকম জঞ্জাল, সবকিছু পার হয়ে সে বড় একটা ঘরে হাজির হল। এই ঘরটির এক কোণায় খানিকটা জায়গা পরিষ্কার করে সেখানে বিছানাপত্র গোটানো আছে। দারোয়ান মানুষটি নিশ্চয়ই রাত্রিবেলা এখানে ঘুমায়। রাজু সাবধানে চারিদিকে তাকিয়ে আরেকটু এগিয়ে যায়। সামনে আরেকটি ঘর, সেখানে থেকে একটা সিঁড়ি উপরে উঠে গেছে। মেয়েটাকে দোতলায় কোনো ঘরে আটকে রাখা আছে, কাজেই রাজু সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে থাকে।
সিঁড়িটা জরাজীর্ণ, একসময় নিশ্চয়ই রেলিং ছিল, এখন ভেঙেচুরে গেছে। রাজু সাবধানে দেয়াল ধরে উপরে উঠে যায়। দোতলায় বেশ অনেকগুলি ঘর, বেশির ভাগই ধসে পড়ে যাচ্ছে, শুধু একটি ঘরে নতুন কাঠের শক্ত দরজা লাগানো হয়েছে, সেই দরজায় একটা তালা ঝুলছে। এই ঘরটাতে নিশ্চয়ই মেয়েটিকে আটক রেখেছে, গাছের উপরে উঠে এইদিকেই সে বাইনোকুলার দিয়ে দেখেছিল। রাজু পা টিপে টিপে এগিয়ে গিয়ে তালাটা হাত দিয়ে দেখে, আজগর মামার বাসাতেও ঠিক এরকম তালা। হঠাৎ আর একটা কথা মনে হল, এমন কি হতে পারে–আজগর মামার বাসায় তালার যে-চাবি রয়েছে সেটা দিয়ে এই তালাটা খোলা যাবে? তালাগুলি দেখতে একই রকম, চাবিগুলিও যদি মিলে যায়? রাজুর পকেটেই মামার বাসার তালার চাবিগুলি রয়েছে–সে সাবধানে পকেট থেকে চাবির রিং বের করে সবরকম দোয়া-দরুদ পড়ে তালাটা খোলার চেষ্টা করল, কিন্তু তালাটা খুলল না।
রাজু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এক মুহূর্ত চিন্তা করল, সে কি দরজায় শব্দ করে এখান থেকে মেয়েটার সাথে কথা বলবে? কিন্তু সামনাসামনি একজন আরেকজনকে না দেখে কথা বলাটা রাজুর বেশি পছন্দ হল না। সে হেঁটে পাশের ঘরটিতে গেল, দরজার-জানালা ভেঙে পড়ে আছে, ভিতরে নানারকম জঞ্জাল। সে জানালার কাছে গিয়ে উঁকি দিল, কার্নিস ধরে হেঁটে পাশের ঘরের জানালার সামনে যাওয়া যেতে পারে, পা পিছলে গেলে নিচে পড়ে যাবে, কিন্তু শুধুশুধু তো আর কারও পা পিছলে যেতে পারে না। রাজু কার্নিসে নামার আগে একটু এদিক সেদিক দেখে এল, হঠাৎ করে যদি আগুনালির শিষ শোনা যায় তা হলে ছুটে পালাতে হবে। সামনের দরজা দিয়ে পালানোর সুযোগ হবে না, অন্য কোন দিকে দিয়ে যাওয়া যেতে পারে ভালো করে দেখে রাখল। পুরো বাসটাই একটা ধ্বংসস্তূপের মতো, কাজেই অনেক দিক দিয়ে পালানোর সুযোগ রয়েছে। ইচ্ছে করলে এই কার্নিস ধরে সামনে গিয়েই একটা ভাঙা দেয়াল ধরে নেমে যাওয়া যাবে। জায়গাটা ভালো করে পরীক্ষা করে সে সাবধানে কার্নিস ধরে হাঁটতে থাকে। কয়েক পা এগিয়ে গিয়েই জানালা, সে কাছে যেতেই দেখল মেয়েটি
জানালার শিক ধরে একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার, মেয়েটার চোখে একটুকু বিস্ময় নেই, অত্যন্ত শান্ত চোখে সে রাজুর দিকে তাকিয়ে আছে। বাইনোকুলারে মেয়েটাকে যেটুকু সুন্দর মনে হয়েছিল সামনাসামনি সে তার থেকে অনেক বেশি সুন্দর। হঠাৎ দেখল কেমন যেন নিঃশ্বাস আটকে আসে।
রাজু একটু হকচকিয়ে গেল, তারপর সে এমন একটা ভান করল যেন কার্নিস ধরে হেঁটে হেঁটে এসে তালা দিয়ে আটকে-রাখা একটা মেয়ের সাথে দেখা করা খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। সে একটু হাসিহাসি মুখ করে বলল, “আমি রাজু। তোমার নাম কী?”
মেয়েটা এমনভাবে রাজুর দিকে তাকিয়ে রইল যে তার মনে হল সে তার কথা শুনতে পায়নি। রাজু আবার কী-একটা বলতে যাচ্ছিল, তখন মেয়েটা বলল, “তুমি এখানে কেন এসেছ, রাজু?”
“আমি–আমি–মানে আমি দেখতে এসেছি তোমার কোনো বিপদ হয়েছে কি না।”
“আমার যদি বিপদ হয় তুমি কী করবে?” রাজু একটু থতমত খেয়ে বলল, “তোমাকে সাহায্য করব।”
“সত্যি?”
“সত্যি।”
“আমাকে ছুঁয়ে বলো–” বলে মেয়েটি জানালা দিয়ে তার হাত বাড়িয়ে দিল।