আব্বা আর আম্মার মাঝে সমস্যা যে, দুজনেই খুব তেজি মানুষ–কখনও কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলেন না। হয়তো খবরের কাগজে উঠেছে–একজন মানুষ বাড়ি এসে দেখেছে বউ ভাত রান্না করেনি, সে রেগে এত জোরে বউকে মেরেছে যে, বউ মরেই গেছে প্রায় প্রত্যেকদিনই এরকম খবর দু-চারটা থাকে, আর এরকম খবর আম্মার চোখে পড়লে কোনো রক্ষা নেই–সমস্ত পুরুষজাতির চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করে ছেড়ে দেন। আব্বা তখন নিরীহ পুরুষদের পক্ষে একটা দুটো কথা বলেন আর সঙ্গে সঙ্গে আম্মার সাথে ঝগড়া শুরু হয়ে যায়। একবার একটা ঝগড়া শুরু হয়ে গেলে সেটা কোনদিকে মোড় নেবে বলা খুব মুশকিল। মাঝে মাঝে অল্প কিছুদূর অগ্রসর হয়ে থেমে যায়। মাঝে মাঝে সেটা অনেক দূর এগোয়, ঝগড়ার ডালপালা গজায়, কবে আব্বা আম্মাকে কী বলেছিলেন বা আম্মা আব্বাকে কী করেছিলেন সেইসব বৃত্তান্ত চলে আসে। রাজু কিংবা সাগরের সামনে দুজনেই অবিশ্যি খুব সামলে-সুমলে থাকার চেষ্টা করেন, কিন্তু সবসময় যে সেটা সম্ভব হয় সেটা সত্যি নয়–একবার তো আম্মা আব্বার দিকে একটা গ্লাস ছুঁড়ে মারলেন, গ্লাস ভেঙে পানি পড়ে একটা একাকার অবস্থা। ঝগড়াগুলি অবিশ্যি খুব বেশি দিন টিকে থাকে না–এক-দুইদিন পর, কোনো কোনোদিন এক-দুই ঘণ্টা পর মিটমাট হয়ে যায়। তখন আবার আম্মা আর আব্বা খুব হাসিখুশি থাকেন, তাঁদের দেখে বোঝাই যায় না যে তারা ঝগড়া করতে পারেন।
যেমন ধরা যাক আজকের ব্যাপারটা। ছুটির দিন সবাই মিলে বাসায় থাকে হৈ-চৈ করার কথা, ভালোমন্দ কিছু-একটা রান্না করার কথা, বিকালবেলা কোথাও বেড়াতে যাবার কথা–কিন্তু সেসব কিছুই হল না। সকালবেলাতেই আম্মা আর আব্বার মাঝে ঝগড়া লেগে গেল, ঝগড়ার বিষয়বস্তুটা কী সেটা রাজু ঠিক ধরতেও পারল না–আব্বা আম্মা দুজনেই একজন আরেকজনকে খুব খারাপ খারাপ কথা বলতে লাগলেন, আব্বা তখন রেগেমেগে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। আম্মা খানিকক্ষণ একা একা দাপাদাপি করলেন, তারপর আম্মাও ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন, যাবার আগে বলে গেলেন আর কখনও ফিরে আসবেন না। সেটা নিয়ে অবিশ্যি রাজু খুব মাথা ঘামাল না, আম্মা প্রত্যেকবারই ঘর থেকে যাবার আগে বলে যান আর কখনও ফিরে আসবেন না। আম্মা গেলে সাগরের মনে হয় একটু সুবিধেই হয়। ফ্রিজের মাঝে তুলে রাখা চকলেটগুলি বের করে খেতে শুরু করে।
.
বিকেলবেলা প্রথমে আব্বা ফিরে এলেন, তাঁকে ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। কে জানে বাসার বাইরে গিয়ে আব্বা আর আম্মা ঝগড়াঝাটির বাকি অংশটা শেষ করে এসেছেন কি না! ঝগড়াঝাটি মনে হয় খুব পরিশ্রমের ব্যাপার, প্রত্যেকবার একটা বড় ঝগড়া করার পর আব্বা আর আম্মা দুজনকেই দেখে মনে হয় খুব বুঝি পরিশ্রম হয়েছে।
আব্বার চুলগুলি উশকো খুশকো, মুখ শুকনো। বাসায় এসে সোফায় হাঁটুর উপর হাত রেখে অনেকক্ষণ বসে রইলেন। রাজু কয়েকবার সামনে দিয়ে হেঁটে গেলে, মনে হয় তাকে দেখতেই পেলেন না। একসময় আব্বা উঠে গিয়ে ক্যাসেট-প্লেয়ারে একটা গান লাগিয়ে সোফায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লেন। রাজু গানটান শোনে না, শুনতে ভালও লাগে না। বিশেষ করে রবীন্দ্রসংগীত তার দুচোখের বিষ, আর আব্বা বাসায় এসেই রবীন্দ্র-সংগীতের একটা ক্যাসেট লাগিয়ে বসে থাকেন। রাজু পাশের ঘরে বসে বসে রবীন্দ্র-সংগীত শুনতে লাগল–টেনে টেনে গাইছে শুনলেই কেমন জানি মন-খারাপ হয়ে যায়।
ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করে রাজু নিজের ঘরে ফিরে এল। তার ঘরটা অবিশ্যি তার একার নয়–তার এবং সাগরের। ঘরটা ছোট, দুইপাশে দুটা ছোট ছোট বিছানা, মাঝখানে পড়াশোনা করার জন্য ছোট একটা টেবিল।
একপাশে একটা শেলফ–সেখানে গাদা করে রাখা অনেকরকম গল্পের বই। একটা বিছানায় সাগর ঘুমিয়ে আছে, অসময়ের ঘুম, বিছানায় অর্ধেক শরীর বাকি অর্ধেক মেঝেতে। একজন মানুষ যে এভাবে ঘুমাতে পারে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। রাজু খানিকক্ষণ চিন্তা করল শরীরের নিচের অংশ উপরে তুলে দেবে, নাকি উপরের অংশ নিচে নামিয়ে দেবে। অনেক ভেবেচিন্তে সে কোনেটাই করল না। হঠাৎ যদি ঘুম ভেঙে যায় তা হলে সাগর হয়তো চিৎকার করেই বাসা মাথায় তুলে ফেলে বলবে, সে এইভাবেই ঘুমাতে চায়, কেন তাকে ঠিক করা হল। সাগরকে নিয়ে যা মুশকিল সেটা আর বলার মতো নয়।
রাজু তার চেয়ারে বসে মাথার নিচে হাত দিয়ে আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। আবার তাকে দেখে মনে হতে লাগল তার পেটব্যথা করছে।
আম্মা এলেন ঠিক সন্ধ্যেবেলায়। ততক্ষণে সাগর ঘুম থেকে উঠে গেছে। অসময়ে ঘুমিয়েছিল, তাই ঘুম থেকে উঠে সাগর খুব মেজাজ করতে লাগল। প্রথমে খানিকক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করে কাঁদল, তারপর এক গ্লাস পানি উলটে ফেলে দুটো বই মেঝেতে ছুঁড়ে দিল। সবার শেষে একটা খেলনা লাথি মেরে ছুঁড়ে দিল দূরে, তারপর সোফায় মুখ ভোঁতা করে বসে রইল। অন্যদিন হলে আম্মা আচ্ছা করে বকে দিতেন, আজকে সারাদিন বাসায় ছিলেন না বলে নিশ্চয়ই আম্মারও খুব খারাপ লেগেছে, তাই সাগরকে কিছু বললেন না। শুধু তাই না, আম্মা ক্যাসেটে একটা গান লাগিয়ে দিয়ে সাগরকে বুকে জড়িয়ে ধরে চুপচাপ সোফায় বসে রইলেন। টেনে টেনে গাওয়া গান, এটা শুনলেও মন-খারাপ হয়ে যায়, নিশ্চয়ই এটাও রবীন্দ্রসংগীত হবে। রবীন্দ্রনাথ কেন যে এতগুলি দুঃখের গান লিখেছেন কে জানে! গান শুনেই কি না কে জানে সাগর আম্মাকে ধরে ফোপাতে লাগল, আর আম্মাও খুব মন-খারাপ করে বসে রইলেন।