রাজু সাগরকে নিয়ে রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করতে থাকে। হেঁটে হেঁটে তারা এক মাথায় চলে যায়, সেখানে একটা ছোট সাঁকো রয়েছে। সাঁকোর উপরে দাঁড়িয়ে তারা নিচের পানির দিকে তাকিয়ে থাকে। ছোট ছোট কচুরিপানা ভেসে ভেসে যাচ্ছে। সাঁকোর উপর দাঁড়িয়ে তারা সেগুলির উপর থুতু ফেলার চেষ্টা করে। কাজটি যত সোজা মনে হয় তত নয়। অনেকক্ষণ সাঁকোর ওপর দাঁড়িয়ে থেকে তারা আবার রাস্তা ধরে নাহার মঞ্জিলের দিকে হেঁটে যেতে থাকে। রাস্তায় একজন চাষি ধরনের বুড়ো মানুষকে খুব উদ্বিগ্ন মুখে হেঁটে যেতে দেখল, দেখে মনে হয় কিছু একটা হারিয়ে গেছে। ঠিক ঐ সময় রাস্তার অন্য পাশে আগুনালিকে দেখা গেল, সে জঙ্গল থেকে বের হয়ে হনহন করে হেঁটে আসছে। উদ্বিগ্ন মুখের বুড়ো মানুষটা আগুনালিকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, “একটা লাল গাই দেখেছ এইদিকে?”
আগুনালি থতমত খেয়ে কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “হ্যাঁ ঐ তো ওখানে ঘাস খাচ্ছে।”
উদ্বিগ্ন বুড়োর মুখে স্বস্তি ফিরে আসে, সাথে সাথে সে গোরুটাকে উদ্ধার করার জন্যে তাড়াতাড়ি হেঁটে যেতে থাকে। আগুনালি নিজেই যে গোরুটাকে ওখানে নিয়ে গেছে জানতে পারলে মনে হয় বড় ঝামেলা ঘটে যেত।
রাজু সাগরকে নিয়ে প্রায় ছুটে গেল আগুনালির কাছে। আগুনালি তার শার্টটা পরতে পরতে বলল, “ব্যাপার কেরাসিন!”
“কেন, কী হয়েছে?”
“ভিতরে অন্য লোকও আছে।”
“অন্য লোক? কয়জন? কীরকম লোক?”
আগুনালি শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে মাটিতে পিচিক করে থুতু ফেলে বলল,”বলছি শোনো।”
আগুনালি খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারে না–যেটা আগে বলার কথা সেটা পরে বলে এবং সেটা পরে বলার কথা সেটা আগে বলে ফেলে। যে-কথাটা বলার কোনো প্রয়োজন নেই সেটা অনেক সময় লাগিয়ে বর্ণনা করে। যেমন গোরুটা কী ধরনের ঘাস খেতে পছন্দ করে এবং কেমন করে ঘাস খায় সেটা কয়েকবার বলে ফেলল। তাকে নানাভাবে প্রশ্ন করে শেষ পর্যন্ত রাজু যে-জিনিসটা বুঝতে পারল সেটা এরকম : আগুনালি গোরুটা নিয়ে হেঁটে হেঁটে নাহার মঞ্জিলের ভাঙা দেয়ালের ফাঁক দিয়ে ভিতরে ঢুকে গিয়ে সামনের ফাঁকা জায়গাতে ঘাস খাওয়াতে খাওয়াতে বাসাটা ভালো করে লক্ষ করছিল। তার অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই সেটা প্রমাণ করার জন্যে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে বাসার দরজায় বসে পড়ল, তখন একটা লোক বের হয়ে তাকে ধমক দিয়ে সেখান থেকে চলে যেতে বলল। লোকটাকে দেখে মনে হল বাসার দারোয়ান। আগুনালি তখন খুব অবাক হবার ভান করে লোকটাকে জিজ্ঞেস করল, এই বাসায় সে কেমন করে থাকে, কারণ রাত হলেই এখানে ভূত আসে। লোকটা বলল, জিন-ভূত কোনোকিছুই সে ভয় পায় না। আগুনালি তখন জানতে চাইল সে এই বাসায় জিন-ভূত কোনোকিছু দেখেছে কি না, কারণ লোজন বলে রাত হলে নাকি এই বাসা থেকে মেয়েলোকের গলার আওয়াজ পাওয়া যায়।
.
মেয়েলোকের গলার আওয়াজের কথা শুনে লোকটা কেমন যেন ঘাবড়ে গেল, তখন সে জানতে চাইল লোকজন আর কী কী কথা বলে। আগুনালি তখন বানিয়ে বানিয়ে আরও কিছু কথা বলল যেন লোকটা কোনোকিছু সন্দেহ না করে। লোকটা কথাবার্তা বেশি বলতে চায় না, তবু খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে যেসব কথা বের করেছে তার থেকে মনে হল কাশেম আলি চৌধুরীর ছেলে হাসান আলি চৌধুরী তাদের বাড়িটা ঠিক করার চিন্তাভাবনা করছে, তাই আপাতত এই মানুষটা পাহারা দেয়ার জন্যে এই বাসায় উঠে এসেছে। মানুষটা বলল, এই বাসায় সে একাই থাকে–আর কেউ থাকে না, যেটা পুরোপুরি মিথ্যা কথা।
রাজু জিজ্ঞেস করল, “কাশেম আলি চৌধুরীর ছেলে কী করে?”
“জানি না।”
“বয়স কত?”
“তাও জানি না।”
তারা যে-রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিল রাস্তাটা মোটামুটি নির্জন, বেশি মানুষের চলাচল নেই। হঠাৎ দেখা গেল, দূর থেকে একজন মানুষ হেঁটে আসছে, আগুনালি মাথা ঘুরিয়ে মানুষটিকে দেখে কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। রাজু জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
“দারোয়ান।”
“নাহার মঞ্জিলের দারোয়ান?”
“হ্যাঁ, আমাকে এখন তোমাদের সাথে দেখে ফেলেছে, কিছু একটানা সন্দেহ। করে ফেলে!”
মানুষটা তাদের দিকে এগিয়ে আসছে, কিছু করার উপায় নেই। তিনজন কিছুই হয়নি এরকম একটা ভাব করে লোকটাকে পাশ কাটিয়ে হেঁটে যেতে থাকে। মানুষটা সরু চোখে তাদের দেখল, এবং হঠাৎ আগুনালিকে চিনতে পেরে কেমন যেন চমকে উঠল। তাকে কিছু-একটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই তারা তাড়াতাড়ি হেঁটে সরে গেল। মানুষটা হেঁটে যেতে যেতে একটু পরে পরে পিছন ফিরে তাকাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছে না।
আগুনালি মাথা চুলকে বলল, “দারোয়ানটা আমাকে চিনে ফেলেছে। ঝামেলা হয়ে গেল।”
রাজু চিন্তিত মুখে মাথা নাড়ল। সাগর বলল, “এখন বাসায় কোনো দারোয়ান নেই, গিয়ে মেয়েটার সাথে কথা বলতে চাও?”
রাজু চমকে উঠে সাগরের দিকে তাকাল, তারপর বলল, “সাগর ঠিক বলেছে। এই সুযোগ!”
আগুনালি ইতস্তত করে বলল, “কী জিজ্ঞেস করবে মেয়েটাকে?”
“জিজ্ঞেস করব কেন আটকে রেখেছে, কে আটকে রেখেছে–এইসব।”
“সত্যি?”
“সত্যি না তো মিথ্যা? চলো তাড়াতাড়ি যাই।”
সাগর জিজ্ঞেস করল, “আমরা সবাই যাব?”
“না। একজন যাব, অন্য দুইজন বাইরে থাকবে, হঠাৎ যদি দারোয়ানটা এসে যায় তা হলে যেন সাবধান করা যায়।”