আগুনালি দাঁত বের করে হেসে বলল, “আর থাকলেই ক্ষতি কী? তোমার হাতে ঐ বড় লাঠিটা দিয়ে দড়াম করে মাথায় মাঝে একটা বসিয়ে দিও, বাঘ ভালুক বাপ বাপ করে পালাবে।”
সাগরকে নিয়ে কেউ ঠাট্টা করলে সে খুব রেগে যায়, এবারেও সে রেগে গেল, কিন্তু রেগে গিয়েও সে কিছু বলল না। সত্যি সত্যি যদি দুষ্টু মানুষেরা একজনকে আটকে রেখে থাকে, তা হলে তাকে উদ্ধার করার জন্য মনে হয় ঠাট্টা তামাশা একটু সহ্য করতে হবে।
নাহার মঞ্জিলের কাছাকাছি এসে রাজুর বেশ আশাভঙ্গ হল, সত্যি সত্যি এটা পোড়াবাড়ি, পুরো বাড়িটা মনে হচ্ছে ধসে পড়ছে। দেয়াল ভেঙে পড়ে আছে, ইট-পাথরের স্থূপ, পোড়া দরজা-জানালা, দীর্ঘদিন অব্যবহারে সারা বাসায় স্থানে স্থানে গাছগাছড়া উঠে এসেছে। রং-উঠা বিবর্ণ ভয়ংকর একটা ধ্বংসস্তূপ। এরকম বাসায় কোনো মানুষ থাকবে কিংবা কেউ জোর করে কাউকে আটকে রাখবে বলে মনে হয় না। তবুও সে গাছের আড়ালে লুকিয়ে থেকে আজগর মামার বাইনোকুলারটা দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে, কিন্তু পুরো বাসায় যে কোনো জনমানুষের চিহ্ন খুঁজে পেল না। রাজুর সাথে সাথে আগুনালিও দেখল, সাগরও দেখল, কিন্তু কোনো লাভ হল না।
এক পাশ থেকে কিছু না দেখে তারা সাবধানে বাসার অন্যপাশে গিয়ে আবার বাসাটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে, সেখানেও কোনো মানুষের চিহ্ন নেই। এতক্ষণে সাগর আর আগুনালি এই ভাঙা বিধ্বস্ত বাসার মানুষ খোঁজাখুঁজি করায় উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। সাগর বিরক্ত হয়ে একটা গাছের গোড়ায় বসে একটু পরে পরে বলতে লাগল, “চলো মাকড়শা-কন্যা দেখতে যাই।”
সাগরের মাথায় কিছু-একটা ঢুকে গেলে খুব বিপদ, তখন সে ভাঙা রেকর্ডের মতো একটা জিনিস বারবার বলতে থাকে। রাজুর ধৈর্য ছুটে যাবার মতো অবস্থা হল। সাগরের এই ঘ্যানঘ্যান থেকে দূরে সরার জন্যে এবং একই সাথে একটু ওপর থেকে দেখার জন্যে সে সাবধানে একটা গাছ বেয়ে ওপরে উঠবে বলে ঠিক করল। আগুনালিকে কথাটা বলতেই সে ভুরু কুঁচকে বলল, “তুমি আগে গাছে উঠেছ?”
“বেশি উঠিনি, কিন্তু উঠেছি।”
“জুতা জোড়া খুলে যাও।”
রাজু জুতা জোড়া খুলে গাছে ওঠার চেষ্টা করতে থাকে। নিচে ডালপালা বেশি নেই, তাই আগুনালি তাকে ঠেলেঠুলে একটু ওপরে তুলে দেয়, বাকি অংশটুকু তখন মোটামুটি সহজ হয়ে গেল। গাছ বেয়ে বেয়ে অনেকটুকু ওপরে উঠে সে আবার নাহার মঞ্জিলের দিকে তাকাল। নিচে থেকে একেবারে বোঝা যায় না, কিন্তু ওপরে বেশ কয়েকটি ঘর রয়েছে এবং এই ঘরগুলো বেশি ভেঙেচুরে যায়নি। সে তীক্ষ্ণ চোখে ঘরগুলোর দিকে তাকাল, একটা জানালা দিয়ে মনে হল ভিতরে দেখা যাচ্ছে এবং হঠাৎ মনে হল ভিতরে কিছু-একটা নড়ছে। সে তাড়াতাড়ি বাইনোকুলারটি চোখে লাগিয়ে জানালার দিকে তাকায়। বাইনোকুলার ফোকাস করতেই জানালাটি ওর একেবারে চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, অবাক হয়ে দেখে সত্যি জানালা দিয়ে ভিতরে কিছু-একটা দেখা যাচ্ছে, আবছা মনে হচ্ছে। একজন মানুষ নড়ছে।
রাজুর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, সে চোখ বড় করে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ দেখতে পেল ঘরের ভিতরে থেকে মানুষটি জানালার কাছে এসে জানালার শিক ধরে বাইরে তাকাল, রাজু প্রায় চিৎকার করে উঠছিল, অনেক কষ্ট করে নিজেকে সামলে নেয়। ঠিক তার বয়সী একটা মেয়ে জানালার শিক ধরে তার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে আছে। রাজু তাড়াতাড়ি তার চোখ থেকে বাইনোকুলারটি নামিয়ে নেয়। না, মেয়েটি কাছে নয়, বহুদূরে জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এইদিকে তাকিয়ে আছে সত্যি, কিন্তু তাকে দেখছে না।
আগুনালি নিচে থেকে চাপাস্বরে জিজ্ঞেস করল, “কী হল, কাউকে দেখলে?”
রাজু আবার চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে বলল, “হ্যাঁ দেখেছি।”
“সত্যি? কে?’
“দাঁড়াও বলছি–”রাজু আবার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আবিষ্কার করল মেয়েটির মাঝে একধরনের অস্বাভাবিক সৌন্দর্য আছে যেরকম আগে কখনও তার চোখে পড়েনি। এত সুন্দর মানুষের চেহারা কেমন করে হয়? রাজুর মনে হতে থাকে মেয়েটি বুঝি মানুষ নয়, বুঝি কোনা অশরীরী প্রাণী। বুঝি আকাশের পরী।
মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ তার বুকের মাঝে একটা ভয়ংকর কষ্ট হতে শুরু করে। কেউ তাকে বলে দেয়নি, কিন্তু তবু সে বুঝতে পারে এই মেয়েটি খুব দুঃখি মেয়ে। পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য নিয়েও মেয়েটির মতো দুঃখি মেয়ে সারা পৃথিবীতে আর একটিও নেই। রাজু রুদ্ধ নিঃশ্বাসে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইল, আর ঠিক তখন মেয়েটি দুই হাত দিয়ে তার মুখ ঢেকে নেয়, তারপর জানালার শিকে মাথা লাগিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মেয়েটি কি কাঁদছে?
আগুনালি নিচে থেকে বলল, “কী হল?”
রাজু চাপাস্বরে বলল, দাঁড়াও বলছি।”
আবার সে মেয়েটির দিকে তাকাল, দুই হাত থেকে মুখটি তুলে সে আবার তাকাল রাজুর দিকে। রাজু তাড়াতাড়ি বাইনোকুলার সরিয়ে নেয় চোখ থাকে। না, মেয়েটি তাকে দেখেনি, এদিকে তাকিয়ে আছে সত্যি, কিন্তু তাকে দেখছে না। রাজু আবার চোখে বাইনোকুলার তুলে নেয় মেয়েটি জানালার শিকে মুখ লাগিয়ে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে খুব ধীরে ধীরে ঘুরে ঘরের ভিতরের দিকে চলে গেল। যাওয়ার ভঙ্গিটি এত দুঃখের যে হঠাৎ রাজু মনে হল সে তার বুঝি বুক ভেঙে যাবে।