“কী?”
“আমাদের এখনই গিয়ে জায়গাটা ভালো করে দেখা উচিত।”
“এখনই?”
“হ্যাঁ। যদি সত্যি কেউ কাউকে আটকে রেখে থাকে তা হলে যত দেরি হবে ততই তো বিপদ বাড়তে থাকবে।”
আগুনালি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “সত্যি যদি কেউ কাউকে আটকে রেখে থাকে তা হলে অনেকদিন থেকে আটকে রেখেছে, আরও দুই-এক ঘণ্টা দেরি হলে কোনো অসুবিধে হবে না।”
রাজু বলল, “তা ঠিক। তা ছাড়া সাগর ঘুম থেকে না ওঠা পর্যন্ত আমরা তো যেতেও পারব না।
রাজু একটু অস্থিরভাবে ঘরের এক পাশ থেকে অন্য পাশে হেঁটে এসে বলল, “সাগরটা যা ঘুমাতে পারে, ওকে ঠেলে না তুললে কোনোদিন ঘুম থেকে উঠবে না!”
আগুনালি বলল, “আহা, ছোট মানুষ। ঘুমাক।” যতক্ষণ ঘুমাচ্ছে ততক্ষণে আমরা নাস্তা তৈরি করে ফেলি।”
আগুনালি দাঁত বের করে হেসে বলল, “খাঁটি কথা! কী আছে নাস্তা তৈরি করার?”
রাজু মাথা চুলকে বলল, “মুড়ি ছাড়া আর কিছু নেই। মনে হয় একটা-দুটা ডিম থাকতে পারে। কয়টা বিচিকলাও আছে মনে হয়।”
নাস্তার বর্ণনা শুনে আগুনালি মোটেও দমে গেল না, হাতে কিল দিয়ে বলল, “ডিম আর মুড়িভাজি ফাস্ট ক্লাস নাস্তা! সাথে চা। সকালবেলা কড়া এক কাপ চা না খেলে শরীরটাতে জুত হয় না! চুলাটা কোন দিকে?”
সকালের উঠে চুলা জ্বালিয়ে রান্নাবান্না শুরু করার রাজুর কোনো ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু সে ভুলেই গিয়েছিল আগুনালির আনন্দই হচ্ছে আগুনে। একটু পরেই দেখা গেল চুলায় দাউ দাউ করে বিশাল একটা আগুন জ্বলছে এবং তার সামনে আগুনালি মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। আগুনটা খানিকক্ষণ উপভোগ করে চুলার মাঝে কড়াই চাপিয়ে তেল ঢেলে তেলটা গরম হওয়ার পর তার মাঝে পেঁয়াজ মরিচ কেটে দিয়ে খানিকক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করে সে ডিমগুলি ভেঙে ছেড়ে দিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকে। আগুন নিয়ে আগুনালির কোনো ভয় নেই, তাই তার কাজকর্ম খুব ঝটপটে, মনে হয় সাংঘাতিক একজন বাবুর্চি। তারপর কড়াই ভরে মুড়িগুলি ভাজা করে আগুনালি সেটা চুলা থেকে নামিয়ে নিয়ে কেতলি চাপিয়ে দেয়। আগুনের আঁচে তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে, কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে সেটা তার ভালোই লাগছে। কেতলির পানি ফুটে উঠলে সেখানে চায়ের পাতা দিয়ে বলল, “নাস্তা রেডি, সাগরকে ডেকে তোলো।”
সাগরকে সকালবেলা ঘুম থেকে ডেকে তোলা খুব সহজ কাজ নয়, কিন্তু আজকে ব্যাপারটা খুব কঠিন হল না। সে চোখ কচলে ঘুম থেকে উঠে জিজ্ঞেস করল, “আজগর মামা কি এসেছেন?”
“না।”
“তা হলে চান মিয়া?”
“না।”
“তা হলে নাস্তা তৈরি করছে কে?”
“আগুনালি।”
“আগুনালির নাম শুনেই সে গুটিগুটি বিছানা থেকে নেমে হাতমুখ ধুয়ে আসে।
আগুনালির তৈরি ডিম এবং মুড়িভাজাটা খেতে খুব ভালো হলেও চা-টা মুখে দেওয়া গেল না। দুধ নেই বলে সেটা কালো এবং তিতকুটে। সাগর মুখে দিয়ে বলল, “ইয়াক থুঃ!”
আগুনালি উষ্ণ স্বরে বলল, “কী হয়েছে? লিকার চা খাও নাই কোনোদিন?”
রাজু বলল, “এটা মোটেও লিকার চা না। এটা ইঁদুর মারার বিষ। এক কাপ খেলে পেটের নাড়িভুঁড়ি ছিদ্র হয়ে যাবে।”
রাজুর কথাটা ভুল প্রমাণ করার জন্যেই মনে হয় আগুনালি কুচকুচে কালো বিষের মতো চা-টা এক ঢোকে শেষ করে দিল। শুধু তা-ই না, ঠোঁটে চেটে বলল, “ফাস্ট ক্লাস!”
রাজু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “চলো, এখন যাই।”
সাগর জিজ্ঞেস করল, “কোথায়? মাকড়শা-কন্যা দেখতে?”
“না, নাহার মঞ্জিলে।”
“সেখানে কেন? দিনের বেলা তো আর সেখানে ভূত থাকবে না।”
“না।” রাজু একটু ইতস্তত করে বলল, “আসলে আমার মনে হয় ঐ নাহার মঞ্জিলে একটা মেয়েকে দুষ্টু মানুষেরা বেঁধে রেখেছে।”
সাগরের চোখ বড় বড় হয়ে গেল সাথে সাথে। একবার রাজুর দিকে, আরেকবার আগুনালির দিকে তাকাল সে সত্যি কথা বলছে, নাকি তার সাথে ঠাট্টা করছে বোঝার জন্য। রাজী গম্ভীর মুখ করে বলল, “আমরা এখনও জানি না সেটা সত্যি কি না। কিন্তু যদি সত্যি হয় তা হলে আমাদের পুলিশকে বলতে হবে।”
সাগরের চোখ হঠাৎ উত্তেজনায় চকচক করতে থাকে, সে একবার ঢোক গিয়ে বলল, “ভাইয়া, চলো মামার বন্দুকটা নিয়ে যাই–বন্দুক দেখলে সব দুষ্টু মানুষ সারেন্ডার করে ফেলবে–”
রাজু হাসি চেপে বলল, “প্রথমেই বন্দুক নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই। আগে জায়গাটা দেখে আসি।”
সাগর সাথে সাথে উঠে দাঁড়াল, বলল, “চলো যাই।”
.
একটু পরে দেখা গেল তিন সদস্যের এই দলটি রাস্তা ধরে হাঁটছে। সবার সামনে সাগর–তার হাতে একটা লম্বা লাঠি। সবার পিছনে রাজু তার গলা থেকে বাইনোকুলারটা ঝুলছে, তার মুখ গভীর চিন্তাগ্রস্থ–দেখে মনে হচ্ছে বুঝি পেটব্যথা করছে। মাঝখানে আগুনালি, এক হাতে সে একটার পর একটা দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে যাচ্ছে। নাহার মঞ্জিলের কাছাকাছি এসে রাজু দাঁড়িয়ে গেল। আগুনালি কাছে এসে বলল, “কী হয়েছে?”
“আমাদের ওই বাসাটার কাছে লুকিয়ে যেতে হবে।”
“কেন?”
“বাসায় যদি সত্যি সত্যি থাকে তা হলে আমাদের দেখে সাবধান হয়ে যাবে।”
আগুনালি কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে বলল, “চলো তা হলে এই জঙ্গলে ঢুকে যাই, জঙ্গল দিয়ে জঙ্গল দিয়ে চলে যাব।”
সাগর ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করল, “এই জঙ্গলে বাঘ-ভালুক নেই তো?”
আগুনালি কিছু বলার আগেই রাজু বলল, “না সাগর, তোকে আমি কতবার বলেছি এইসব জঙ্গলে বাঘ-ভালুক থাকে না।”