হঠাৎ পুরুষকণ্ঠের একটা চিৎকার শোনা গেল। কেউ যেন খুব রেগে কিছু একটা বলছে, তারপর মেয়েলি গলায় একটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ। রাজুর সারা শরীর আতঙ্কে থরথর করে কেঁপে ওঠে। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “চলো যাই।”
আগুনালি ফিসফিস করে বলল, “আর দেখবে না?”
“না।”
“চলো তা হলে। ভয়ের কিছু নাই। খবরদার কেউ দৌড় দিও না। দৌড় দিলে ভয় বেশি লাগে। হেঁটে হেঁটে চলল।”
আগুনালির পিছনে সাগর, সাগরের পিছনে রাজু। খুব কাছাকাছি থেকে একজন আরেকজনকে ধরে তাড়াতাড়ি হেঁটে জায়গাটা পার হয়ে এল। ঝোঁপঝাড় ভেঙে যখন তারা বড় সড়কটাতে উঠে পড়ল তখন অন্ধ-ভয়টা একটু কমে এল–রাজু শেষবারের মতো পিছনে তাকাল–তার ভুলও হতে পারে, কিন্তু মনে হল পিছনে নাহার মঞ্জিল থেকে ক্ষীণ একটা আলোর রেখা বের হয়ে আসছে।
সারা রাস্তায় কেউ কোনো কথা বলল না। বাসায় পৌঁছানার পর তালা খুলে ঘরের ভিতরে ঢোকার পর আগুনালি দাঁত বের করে হেসে বলল, “ভূত দেখলে?”
রাজু আর সাগর মাথা নাড়ল।
”ভয় পেয়েছিলে?”
“পেয়েছিলাম।”
সাগর ফ্যাকাশে মুখে বলল, “এখনও ভয় লাগছে।”
“একা একা থাকতে পারবে?”
রাজু ভীত মুখে একবার সাগরের দিকে তাকাল, তারপর আগুনালির দিকে তাকাল। আগুনালি সাহস দেওয়ার মতো করে বলল, “কোনো ভয় নাই। যদি চাও তো আমার তাবিজটা দিয়ে যাই”
“তাবিজ লাগবে না–রাজু ইতস্তত করে বলল, তুমি আজকে এখানে থেকে যাও।”
“আমি?”
“হ্যাঁ।”
আগুনালি মাথা চুলকে বলল, “বাড়িতে বলে আসি নাই, কিন্তু সেইটা নিয়ে অসুবিধে নাই। তবে–”
“তবে কী?”
“খাওয়া হয় নাই–”
“আমাদের অনেক খাবার বেঁচে গেছে। তোমাকে গরম করে দিই।”
“আরে ধুর! খাবার আবার গরম করতে হয় নাকি?”
খেয়েদেয়ে শোবার আগে আগুনালি দাঁত বের করে হেসে বলল, “আমার বাজির টাকাটা?”
রাজু কোনো কথা না বলে ব্যাগ খুলে সেখান থেকে দশ টাকার বের করে আগুনালির হাতে দেয়। সে কখনও চিন্তা করেনি এরকম একটা বাজিতে সে হেরে যাবে।
৫. পঞ্চম দিন
ঘুম থেকে উঠে রাজু তার বিছানায় সোজা হয়ে বসে। রাত্রে ঘুম আসতে দেরি হয়েছে, কিন্তু সকালে ঘুম ভেঙেছে বেশ তাড়াতাড়ি।
বালিশে হেলান দিয়ে বসে সে গতরাতের ব্যাপারটা আবার চিন্তা করতে বসে, কিছুক্ষণের তা মুখ দেখে মনে হতে থাকে তার বুঝি পেটব্যথা করছে।
আগুনালির ঘুম থেকে উঠে দেখতে পেল রাজু পাথরের মূর্তির মতো চুপচাপ বসে আছে, সে আগে কখনও তাকে এভাবে দেখেনি। ভয়ে ভয়ে ডাকল, “রাজু”
রাজু যখন গভীর চিন্তায় ডুবে থাকে তখন কেউ সহজে ডেকে তার সাড়া পায়। কিন্তু এবারে রাজু সাথে সাথে মাথা ঘুরিয়ে আগুনালির দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার কী মনে হয় জান?”
আগুনালি থতমত খেয়ে বলল, “কিসের কী মন হয়?”
“কালকে রাত্রে যে আমরা ভূত দেখেছিলাম”
“কী হয়েছে সেই ভূতের?”
“আসলে সেটা ভূত ছিল না।”
আগুনালি এবারে একটু রেগে গেল। রেগে গিয়ে বলল, “কী ছিল তা হলে?”
“আমার মনে হয় এই বাসটায় কোনো মানুষ আছে।”
“মানুষ?”
“হ্যাঁ। একজন মেয়েমানুষ। সত্যিকারের মেয়েমানুষ।”
আগুনালি অবাক হয়ে রাজুর দিকে তাকিয়ে রইল। খানিকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারল না। তারপর যখন বলার চেষ্টা করল তখন কোনো কথা বের না হয়ে সে তোতলাতে শুরু করল, বলল, “তো-তো-তা-তোমার মা-মাথা খারাপ হয়েছে? ওখানে মা-মা-মা মানুষ আছে?”
“নিশ্চয়ই আছে। না হলে কাল রাতে আমরা চিৎকার শুনলাম কিসের? সত্যি সত্যি তো আর ভূত আসতে পারে না!”
আগুনালির মুখ রাগে থমথম করতে থাকে। সে হাতড়ে হাতড়ে বালিশের নিচে থেকে ম্যাচটা বের করে একটা কাঠি বের করে বুড়ো আঙুল দিয়ে চেপে ধরে ফস করে জ্বালিয়ে মেঝেতে ছুঁড়ে দেয়, আগুনটা না নেভা পর্যন্ত সেদিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “তার মানে তুমি তোমার টাকা ফেরত চাও?”
রাজু এবারে হেসে ফেলল। বলল, “আমি সেটা বলিনি। তোমার টাকা তুমি রাখো। আমি বলছি, যদি মনে কর সত্যিই ওই বাসায় কোনো মেয়েমানুষ আছে, কেউ তাকে ধরে আটকে রেখেছে, তা হলে আমাদের কি কিছু করা উচিত না?”
“কী করা উচিত?”
“তার কথা পুলিশকে গিয়ে বলা।”
আগুনালি এবারে মুখ বাঁকা করে হেসে বলল, “তুমি ভেবেছ পুলিশ তোমার কথা বিশ্বাস করবে? কোনোদিন বিশ্বাস করবে না।”
“সেটা পরে দেখা যাবে। আমাদের কথা বিশ্বাস না করলে আজগর মামাকে নিয়ে যাব।”
“পরে পুলিশ যদি গিয়ে দেখে আসলেই কেউ নেই, শুধু ভূত?”
রাজু মাথা চুলকে বলল, “আমার মনে হয় দিনের বেলা গিয়ে আমাদের জায়গাটা পরীক্ষা করে দেখা দরকার।”
আগুনালি কোনো কথা না বলে রাজুর দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইল।
“দেখেশুনে যদি মনে হয় মানুষ আছে তা হলে পুলিশকে বললেই হবে।”
আগুনালি আরেকটা ম্যাচের কাঠি বুড়ো আঙুল দিয়ে ঘষে জ্বালিয়ে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, “যদি ওইখানে কোনো বদমাইশ মানুষ অন্য মানুষকে ধরে আটকে রেখে থাকে তা হলে সে তোমাকে কি কোলে তুলে আদর করবে?”
“না, তা করবে না। তাই কাজটা হবে লুকিয়ে।”
“পরিষ্কার দিনের বেলা সেটা তুমি কীভাবে করবে?”
রাজু আবার মাথা চুলকে বলল, “প্রথমে শুধু বাইরে থেকে দেখব। মামার বাইনোকুলারটা নিয়ে যাবে, সেটা দিয়ে দূর থেকে খুব পরিষ্কার দেখা যাবে।”
আগুনালি কোনো কথা না বলে আরেকটা ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে ছুঁড়ে দিল। রাজু হঠাৎ বিছানা থেকে নেমে বলল, “আমার কী মনে হয় জান?”