“কেন?”
“সাথে আলো থাকলে ভূত আসে না। তা ছাড়া আলো না জ্বালালে চোখে আস্তে আস্তে অন্ধকার সয়ে যায়, তখন অন্ধকারেই সব স্পষ্ট দেখা যায়।”
রাজু প্রথম আগুনালির কথা বিশ্বাস করেনি, কিন্তু একটু পরেই দেখল তার কথা সত্যি। প্রথম যখন ঘর থেকে বের হয়েছিল মনে হচ্ছিল চারপাশে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার–এক হাত দূরের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু কিছুক্ষণেই চারপাশের সবকিছু বেশ স্পষ্ট হয়ে এল। রাস্তা, রাস্তার পাশে গাছপালা–সবকিছু আবছাভাবে বোঝা যায়। আকাশে ছোট একটা চাঁদ, সেটা থেকে অল্প একটু আলো ছড়িয়ে পড়েছে, কিন্তু সেই অল্প আলোতেই যে এত কিছু দেখা সম্ভব কে জানত!
হাঁটতে হাঁটতে রাজু জিজ্ঞেস করল, “আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? কারও বাড়িতে?”
আগুনালি মাথা নাড়ল, “না, ঠিক বাড়িতে না।”
“তা হলে কি শ্মশানে?”
“না। ঐসব জায়গায় যাওয়া ঠিক না। খারাপ রকমের জিনিস থাকে। তাবিজেও কাজ হয় না।”
“তা হলে কোথায়?”
“এই এলাকায় একটা বড় বাড়ি ছিল। নাম ছিল নাহার মঞ্জিল। বড় বাড়ি, বিশাল এলাকা দেয়াল দিয়ে ঘেরা। সেই বাড়িতে থাকত কাশেম আলি চৌধুরী। বড় রাজাকার ছিল কাশেম আলি। এই এলাকায় যখন পাকিস্তানি মিলিটারি আসত তার বাড়িতে ঘাঁটি করত। মানুষজনকে ধরে নিত তার বাড়িতে, অত্যাচার করে গুলি করে মারত তাদেরকে। অনেক মেয়েকেও মেরেছে–অনেকে নিজের গলায় দড়ি দিয়ে মারা গেছে।”
“কেউ কিছু বলেনি?”
“যুদ্ধের সময় ভয়ে কিছু বলে নাই। যখন যুদ্ধ শেষ হয়েছে তখন এলাকার মানুষেরা পুরো বাড়িটা পুড়িয়ে দিয়েছে।”
“আর কাশেম আলি?”
“সেই ব্যাটা পাকিস্তানে পালিয়ে গেছে। তাকে ধরতে পারে নাই। ধরতে পারলে জ্যান্ত তার চামড়া ছিলে ফেলত।”
“এখন তো সব রাজাকার পাকিস্তান থেকে ফেরত আসছে, সেই ব্যাটা ফিরে আসেনি?”
“জানি না। যা-ই হোক, সেই নাহার মঞ্জিল এখন ভেঙেচুরে পড়ে আছে–বলতে গেলে ভূতের বাড়ি। সেই বাড়িতে এত মানুষ মেরেছে যে জায়গাটা আর ঠিক হয় নাই। রাত গম্ভীর হলেই নানারকম চিৎকার শোনা যায়। মানুষজন এদিক দিয়ে গেলে অনেক কিছু দেখে
“অনেক কিছু কী?”
“এখন বলতে চাই না। শুনলে তোমরা ভয় পাবে।”
শুনেই হঠাৎ রাজুর গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। সাগর ভয় পেল আরও বেশি, হঠাৎ থেমে গিয়ে বলল, “আমি যেতে চাই না। বাসায় যাব।”
আগুনালি বলল, “ভয়ের কিছু নাই, আমরা তো আর নাহার মঞ্জিলের ভিতরে ঢুকব না। দূর থেকে দেখব।”
“দূর থেকে?”
“হ্যাঁ, অনেক দূর থেকে।”
“যখন রাত হবে তখন কথা শুনতে পারবে, ছায়ার মতো জিনিস দেখবে–”
সাগর আবার দাঁড়িয়ে গেল, ভয়-পাওয়া গলায় বলল, “যেতে চাই না। আমি।”
এতদূর এসে ফিরে যাওয়ার কোনো অর্থ হয় না। রাজু সাগরকে বুঝিয়ে রাজি করাল, কানে-কানে বলল, “আমার কাছে টর্চলাইট রয়েছে না? জ্বালিয়ে দেব, সাথে সাথে সব চলে যাবে।
শেষ পর্যন্ত সাগর যেতে রাজি হল। নাহার মঞ্জিল রাস্তা থেকে একটু ভিতরে, একসময়ে নিশ্চয়ই রাস্তা ছিল, দীর্ঘ দিন রাস্তা ব্যবহার করা হয়নি বলে ঝোঁপঝাড়ে ঢেকে আছে। ঝোঁপঝাড় ভেঙে রাজু আর সাগর আগুনালির পিছনে পিছনে যেতে থাকে। নাহার মঞ্জিলের কাছাকাছি পৌঁছে আগুনালি ফিসফিস করে বলল, “এইখানে থামো।”
রাজু ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “বাসাটা কই?”
আগুনালি হাত দিয়ে দূরে একটা টিবির মত জিনিস দেখিয়ে দিল। অন্ধকারে ভালো বোঝা যায় না, কিন্তু একসময় নিশ্চয়ই অনেক বড় বাসা ছিল। রাজু চেষ্টা করেও বাসাটা ভালো করে দেখতে পেল না।
সাগর রাজু আর আগুনালি দুজনের মাঝখানে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়েছিল, কাঁপা গলায় বলল, “কখন আসবে ভূত?”
“কোনো ঠিক নাই। আগুনালি ফিসফিস করে বলল, “এখনও আসতে পারে, আবার দেরিও হতে পারে।”
“আমরা এইখানে দাঁড়িয়ে থাকব?”
“ইচ্ছা হলে বসতেও পার। এই গাছে হেলান দিয়ে।”
রাজু, সাগর আর আগুনালি বড় একটা গাছে হেলান দিয়ে বসে থাকে। কপাল ভাল মশা খুব বেশি নেই, তা না হলে ভূত দেখার শখ মিটে যেত। মাঝে মাঝে একটু-দুইটা মশা পিনপিন করে খোঁজখবর নিয়ে চলে যাচ্ছে, খুব সাহসী হলে টুকুস করে একটা কামড় দিচ্ছে, তার বেশি কিছু নয়।
ওরা কতক্ষণ বসেছিল কে জানে, হঠাৎ আগুনালি ফিসফিস করে বলল, “ঐ দেখো”
রাজু আর সাগর চমকে উঠল, “কোথায়?”
“ঐ যে ওপরে দেখছ সাদামতো কী-একটা নড়ছে–”
রাজু ভালো করে তাকিয়ে হঠাৎ শিউরে উঠল, সত্যি সত্যি সাদামতো কী একটা যেন উপরে ভেসে বেড়াচ্ছে। শক্ত করে সাগরকে ধরে রেখে রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে থাকে–ঠিক তখন সে একটা শব্দ শুনতে পেল মনে হল–একটা মেয়ের গলার স্বর। প্রথমে মনে হল কেউ যেন কিছু-একটা বলছে, তারপর মনে হল কথা বলছে না–কেউ একজন কাঁদছে। একটু পর মনে হল, না কাঁদছে না, কেউ একজন গান গাইছে।
ভয়ে আর আতঙ্কে রাজুর শরীর অল্প অল্প কাঁপতে থাকে। আগুনালি ফিসফিস করে বলল, “ভয়ের কিছু নাই, আমার কাছে পীর সাহেবের তাবিজ আছে।”
সাগর গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, “ভূতেরা কি আমাদের দেখতে পাচ্ছে?”
আগুনালি বলল, “ভূতেরা সবকিছু দেখতে পায়।”
“তা হলে কি আমাদের কাছে আসবে?”
“না, আসবে না।”
রাজু তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকে, আবছা সাদামতো জিনিসটা যেন ভেসে বেড়াচ্ছে, সাথে মেয়েলি গলার একটা শব্দ। হঠাৎ করে শব্দটা থেমে গেল–কোথাও কোনো শব্দ নেই। সাগর ভয়-পাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করল, “কী হল? শব্দ বন্ধ হয়ে গেল কেন?”