আগুনালি খুব কাজের মানুষ, খাওয়া-দাওয়ার পর হোটেলে ম্যানেজারের সাথে কথা বলে ব্যবস্থা করে নিল, প্রত্যেকদিন দুপুরে আর রাত্রে আজগর মামার বাসায় খাবার পৌঁছে দেবে। আগে থেকে কিছু টাকা দিতে হবে কি না রাজু জিজ্ঞেস করতে চাইছিল, ম্যানেজার সাথে সাথে জিবে কামড় দিয়ে বলল, “মাস্টার সাহেবের বাসায় খাবার পাঠাব, তার জন্য অ্যাডভান্স নিলে দোজখেও জায়গা হবে না।”
আজগর মামা ঠিক কী করেন কে জানে, কিন্তু এই এলাকার মানুষজন তাঁকে সত্যি সত্যি ফিরিশতার মতো মনে করে।
হোটেল থেকে বের হয়ে বাজারটা ওরা একটু ঘুরে দেখল। ছোট ছোট নানারকম দোকানপাট আছে, তার মাঝে নানা ধরনের জিনিসপত্র। একপাশে কিছু বেদেনি চুড়ি নিয়ে বসেছে, অন্য পাশে মাটির খেলনা, শোলার পাখি। সাগর একটা শোলার পাখি এবং গলায় স্প্রিং লাগানো মাটির রবীন্দ্রনাথ কিনল, রবীন্দ্রনাথের মাথায় টোকা দিলেই তিনি মাথা নাড়তে থাকেন। আব্বা আর আম্মা দুজনেই রবীন্দ্রনাথের এত বড় ভক্ত যে তারা এটা দেখলে মনে হয় চটে যেতে পারেন।
রাজু আর সাগরকে আগুনালি যখন বাসায় পৌঁছে দিয়ে গেল তখন বিকেল হয়ে গেছে। আগুনালি আর বসল না, সাথে সাথেই চলে গেল, রাত্রিবেলা আবার আসবে ভূত দেখাতে নেওয়ার জন্য। বাসা ওরা যেভাবে তালা মেরে রেখেছিল ঠিক সেভাবেই আছে, চান মিয়ার এখনও দেখা নেই। রাজু অবিশ্যি সেটা নিয়ে ঘাবড়ে গেল না, এখন মনে হচ্ছে চান মিয়াকে ছাড়াই তারা কয়েকদিন চালিয়ে নিতে পারবে।
সারাদিন হেঁটে হেঁটে ওরা খুব ক্লান্ত হয় ফিরে এসেছে। সাগর শোলার পাখিটা হাতে নিয়ে খানিকক্ষণ খেলে সোফায় বসে বসেই হঠাৎ ঘুমিয়ে গেল। ঘুম জিনিসটা মনে হয় সংক্রামক, তাই রাজু ঘুমাবে না ঘুমাবে না করেও শেষ পর্যন্ত চোখ ভোলা রাখতে পারল না। সাগরের দেখাদেখি সেও একটা সোফায় হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
অসময়ে অজায়গায় ঘুমিয়ে গেলে সাধারণত বিচিত্র সব স্বপ্ন দেখা যায়, রাজু সেটা হাড়েহাড়ে টের পেল। সোফায় শুয়ে শুয়ে এমন সব স্বপ্ন দেখতে লাগল যে বলার নয়! স্বপ্নে দেখল দুই মাথাওয়ালা গোরু শিং উঁচিয়ে তাদের তাড়া করে আসছে, রাজু প্রাণ হাতে নিয়ে ছুটছে। তখন হঠাৎ গোরুটা মুখ হাঁ করে বিদঘুঁটে একটা আওয়াজ করল–সাথে সাথে গোরুর মুখ দিয়ে আগুনের হলকা বের হয়ে এল। তখন হঠাৎ আগুনালিকেও দেখা গেল, সে তার আগুনের পিচকারি নিয়ে হাজির হয়ে দুই মাথাওয়ালা গোরুর সাথে যুদ্ধ করতে শুরু করেছে। ঠিক তখন তার আগুনের পিচকারি থেকে আগুন বের না হয়ে ঝাল মাছের ঝোল বের হতে শুরু করেছে স্বপ্নে সেটাও খুব বিচিত্র মনে হচ্ছে না, তাই নিয়েই আগুনালি যুদ্ধ করছে। ওদেরকে ঘিরে লোকজনের ভিড় জমে গেছে আর তাদের চাচামেচিতে রাজুর ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভেঙে উঠে দেখে হোটেল থেকে একটা ছেলে খাবার নিয়ে এসে ডাকাডাকি করছে। ছেলেটা ছোট, সে প্রায় তার সমান-সমান একটা টিফিন-ক্যারিয়ার ভরে খাবার নিয়ে এসেছে। রাজু রান্নাঘরে গিয়ে খোঁজাখুজি করে কিছু বাসনপত্র বের করে সেখানে খাবার ঢেলে রাখল।
ছেলেটা চলে যাবার পর রাজু খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। অসময়ে ঘুমিয়েছে বলে মনটা কেমন জানি ভালো লাগছে না, শুধু আম্মা-আব্বার কথা মনে হচ্ছে। চুপচাপ খানিকক্ষণ মন খারাপ করে বসে থেকে সে সাগরকে ডেকে তুলল। ঘুমের মাঝে ওলটপালট করে তার শোলার পাখিটা ভেঙেচুরে গেছে, ঘুম থেকে উঠে সে সেটা নিয়ে খানিকক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করল। কিন্তু নিজেই ভেঙেছে, বলার কিছু নেই। তার উপর কদিন থেকে কান্নাকাটি করে খুব সুবিধে করতে পারছে না, কেউ শোনার নেই, তাই খামোখা আর কাঁদল না।
দুজনে হাতমুখ ধুয়ে নিয়ে খেতে বসল। আগুনালি হোটেলের ম্যানেজারকে অনেকবার বলে দিয়েছিল যেন ঝাল কম করে দেয়, কিন্তু তবু লাভ হয়নি। সবকিছুতেই আগুনের মতো ঝাল।
আগুনালির শিখিয়ে দেওয়া কায়দায় সবকিছু ডালের মাঝে ধুয়ে নেওয়ার পর তারা মোটামুটি শখ করেই খাওয়া শেষ করল। যে-পরিমাণ খাবার এনেছে সেটা দুজনেই শেষ করার মতো নয়, খাবার বেশির ভাগই পড়ে রইল বাটিতে।
খাওয়া শেষ করে রাজু আর সাগর জুতোমোজা পরে আগুনালির জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। দিনের বেলা ভূত দেখার ব্যাপারটা নিয়ে হাসি-তামাশা করেছে, পুরোটাই একটা মজার জিনিস বলে মনে হয়েছে। কিন্তু রাত্রিবেলা যখন চারিদিক অন্ধকার হয়ে এসেছে, এমনিতেই একটা গা-ছমছমানি ভাব–তখন হঠাৎ করে ভূত দেখতে পাওয়ার ব্যাপারটা থেকে মজার অংশটুকু উধাও হয়ে গিয়ে সেটাকে ভয়ের জিনিস মনে হতে শুরু করেছে।
আগুনালি এসে পৌঁছাল বেশ রাতে। তার সাথে পিচকারির মতো জিনিসটা নেই, হাতে ছোট ছোট দুটো বাঁশের কঞ্চি। রাজু জিজ্ঞেস করল, “এই কঞ্চি দিয়ে কী করবে?”
“তোমাদের জন্যে।”
“আমাদের জন্যে?”
“হ্যাঁ। তোমাদের তো জিন-ভূতের তাবিজ নাই সেইজন্যে। বাঁশের কঞ্চি একটু পুড়িয়ে নিয়ে সাথে রাখলে জিন-ভূত আসে না।”
দিনের বেলা হলে রাজু পুরো ব্যাপারটা নিয়ে হাসাহাসি শুরু করে দিত, কিন্তু এই রাত্রিবেলা সেটা নিয়ে সে হাসাহাসি করল না। কঞ্চি দুটো নিয়ে নিজেদের পকেটে রেখে দিল।
যখন রাজু আর সাগর আগুনালির সাথে বের হল তখন রাত সাড়ে দশটা। ঘর থেকে বের হতেই মনে হল চারিদিকে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। রাজুর হাতে মামার বড় টর্চলাইটটা ছিল, সেটা জ্বালাতেই আগুনালি বলল, “লাইট জ্বালিও না।”