.
কিছুক্ষণ পর দেখা গেল আগুনালির সাথে রাজু আর সাগর বের হয়েছে। প্রথমে দেখতে যাবে দুই মাথাওয়ালা গোরু। জায়গাটা বেশ দূর। প্রথমে খানিকটা জায়গা রিকশা করে যেতে হয়। রিকশা থেকে নেমে বাকি রাস্তা হেঁটে। গ্রামের সড়ক, দুপাশে ধানক্ষেত আর গ্রাম দেখতে ভারি সুন্দর দেখায়। সড়কের মাঝে নরম একধরনের ধুলা, পা ফেললে গেঁথে যায়, ভারি আরাম লাগে তখন। রাজুর ধারণা ছিল সাগর একটু পরেই মেজাজ খারাপ করে কান্নাকাটি শুরু করে দেবে, কিন্তু দেখা গেল তার উৎসাহই সবচেয়ে বেশি। রাস্তায় দৌড়ে দৌড়ে যাচ্ছে, পাশে ঝোঁপঝাড় থেকে ফুল তুল আনছে, পানিতে ঢিল ছুঁড়ছে। এক জায়গায় ঝোঁপঝাড় স্বর্ণলতায় ঢেকে আছে, সেটা খুব কৌতূহল নিয়ে দেখল। আগুনালি স্বর্ণলতা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে তাকে একটা চশমা তৈরি করে দিল, এই চশমা পেয়ে তার আনন্দ দেখে কে! তিনজন তিনটা চশমা পরে হেঁটে যেতে যেতে হেসে কুটিকুটি হয়ে যাচ্ছিল।
দুই মাথাওয়ালার গোরুর জায়গাটা খুঁজে বের করতে বেশি অসুবিধে হল না, আগুনালি আগে এসেছে। একটা গৃহস্থের বাড়ি, বাসার সামনে গাছ, সেই গাছে একটা সাইনবোর্ড। সাইনবোর্ডে খুব কাঁচা হাতে দুই মাথাওয়ালা একটা গোরুর ছবি আঁকা, তার পাশে গোরুর বৃত্তান্ত। এই গোরুর নাকি আল্লার বিশেষ কুদরত এবং এর সাথে শরীর ঘষে দিলেই নাকি বাতের ব্যথা উপশম হয়। এর গোবর পেটে লেপে দিলে গর্ভবতী মহিলাদের প্রসব বেদনা ছাড়া বাচ্চা হয়, এর পেশাব মধুর সাথে মিশিয়ে খেলে নাকি কালাজ্বর এবং ম্যালেরিয়া রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করা যায়। সাইবোর্ডের নিচে বিভিন্ন রকম মূল্য-তালিকা রয়েছে। বাসার সামনে মানুষজনের ভিড়–সবার হাতে শিশি নাহয় কৌটা রয়েছে, মনে হচ্ছে গোরুর গোবর এবং পেশাব কিনতে এসেছে। এইরকম একটা ব্যাপার যে ঘটতে পারে নিজের চোখে না দেখলে রাজু বিশ্বাস করত কি না সন্দেহ।
এক টাকা করে টিকেট কিনে তারা একটা চালাঘরে ঢুকল। ঘরের ভিতরে আবছা অন্ধকার, তার মাঝে আগরবাতি জ্বলছে। ঘরের মেঝেতে একটা কথা বিছানা, সেখানে একটা গোরু দাঁড়িয়ে আছে। গোরুর গলার এক পাশে টিউমারের মতো একটা জিনিস বের হয়ে আছে। সেখানে কাঁচা হাতে চুন এবং আলকাতরা দিয়ে দুটো চোখ আঁকা হয়েছে। হঠাৎ দেখলে একটু চমকে উঠতে হয়, কিন্তু সেটি যে সত্যিকারের মাথা নয় সেটি বুঝতে কোনো অসুবিধে হয় না। উপস্থিত লোকজন কিছু কেউ সেটা নিয়ে একটা কথাও বলছে না। গোরুর কাছে চাপ দাড়িওলা একজন মানুষ দাঁড়িয়েছিল, সে এই গোরুর জন্ম বৃত্তান্ত নিয়ে একটা বড় বক্তৃতা দিল–বক্তৃতার মাঝেই হঠাৎ গোরুর বাথরুম করার প্রয়োজন হল, মানুষটি তখন বক্তৃতা বন্ধ করে এক ছুটে একটা বালতি এনে সেটাতে গোরুর মূল্যবান গোবরটাকে রক্ষা করে ফেলল। পুরো ব্যাপারটা এত বিচিত্র যে রাজু হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকে। বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর কয়েকজন বুড়ো মানুষ শার্ট গেঞ্জি খুলে খালি গা হয়ে গোরুর সাথে শরীর ঘষে নিল, তাদের মুখ দেখে সত্যিই মনে হল তাদের বাতের ব্যথা বুঝি পুরোপুরি ভালো হয়ে গেছে।
রাজু আগুনালিতে খোঁচা দিয়ে বলল, “চলো যাই।”
“আর দেখবে না?”
“না।”
সাগর বের হওয়ার সময় চাপ দাড়িওয়ালা মানুষটাকে গোরুর দুই নম্বর মাথাটা দেখিয়ে বলল, “এইটা তো সত্যিকার মাথা নয়–”
সাগরের কথা শুনে চাপ দাড়িওয়ালা মানুষটা একেবারে থতমত খেয়ে যায়। কী-একটা কথা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই আগুনালি সাগরের হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে চালাঘর থেকে বের করে আনে।
বাইরে বের হয়ে সাগর বলল, “কালি দিয়ে চোখ এঁকেছে! নকল মাথা!”
বাইরে যারা দাঁড়িয়েছিল তাদের যে-কয়জন সাগরের কথা শুনতে পারল সবাই মাথা ঘুরিয়ে সাগরের দিকে চোখ-গরম করে তাকাল। আগুনালি মানুষগুলির দিকে তাকিয়ে কৈফিয়ত দেবার ভঙ্গি করে বলল, “ছোট গোলাপান তো, কী বলতে কী বলে তার ঠিক নাই–”
তারপর সাগর আর রাজুকে নিয়ে সড়ক ধরে হাঁটতে শুরু করে। বেশ খানিক যাবার পর রাজু বলল, “তোমার ভূত কি এইরকম দুই মাথাওয়ালা গোরুর মতো?”
“মানে?”
“এইরকম ফাঁকিবাজি?”
“এটা ফাঁকিবাজি ছিল?”
“ফাঁকিবাজি নয়তো কী! আলকাতরা দিয়ে চোখ এঁকে রেখেছে।”
“তা হলে মানুষ আসছে কেন দেখতে?”
“মানুষ না জেনে আসছে।”
আগুনালি কোনো কথা না বলে খামোখাই তার পিচকারিটা হাতে নিয়ে আকাশের দিকে একটা আগুনের হলকা পাঠিয়ে দিল–বোঝা গেল সে একটু রেগে গেছে।
.
হেঁটে এবং রিকশা করে তারা যখন ফিরে এল তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। বাজারের কাছে একটা হোটেলের সামনে তারা রিকশা থামিয়ে নেমে গেল। আগুনালি বলল, এটা নাকি তার পরিচিত হোটেল। ভিতরের দিকে একটা খালি টেবিলে বসে আগুনালি হাঁক দিল, “কাউলা ভাই, এই টেবিলটা ভালো করে মুছে দেন, এরা মাস্টার সাহেবের ভাগনা।”
আগুনালির খাতিরেই হোক আর আজগর মামার ভাগনে বলেই হোক, কাউলা নামের মানুষটা টেবিল মুছ ধোয়া গ্লাসে পানি এনে দিল। আগুনালি জানতে চাইল খাবার কী আছে। কাউলা নামের মানুষটা যন্ত্রের মতো কী কী মাছ-তরকারি আছে বলে গেল। তার মাঝে কী কী খাওয়া যায় সেটা নিয়ে অনেকক্ষণ আলোচনা করে শেষ পর্যন্ত খাবার অর্ডার দেওয়া হল।
কিছুক্ষণের মাঝেই খাবার চলে এল। থালাবাসন সবই খুব পরিষ্কার, মাছ তরকারি দেখতেও খুব সুন্দর লাগছে, কিন্তু খেতে গিয়ে দেখা গেল খুব ঝাল। রাজু তবু কষ্ট করে খেয়ে নিচ্ছিল। সাগরের খুব ঝামেলা হল, চোখে-নাকে পানি এসে যাচ্ছিল। আগুনালি তখন সাগরের মাছ-তরকারি ডালের মাঝে ধুয়ে দিল, এবং সত্যি সত্যি তখন ঝাল কমে গিয়ে মোটামুটিভাবে খাবারের মতো অবস্থায় এসে গেল।