“আজকেই চলে যাবে? কেন? থাকো কয়দিন।”
“নাহ্!”
“কেন? আমাদের জায়গা ভালো লাগে না তোমাদের?”
“ভালো লাগে। ভালো লাগবে না কেন?”
“তা হলে?”
“আসলে আজগর মামা কয়দিনের জন্যে বাইরে গেছেন। চান মিয়াও নেই। খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট।”
“খাওয়ার কষ্ট? হোটেলে খাও না কেন?”
“হোটেলে?”
“হ্যাঁ, আমার সাথে ইস্পিশাল খাতির, আমি বললেই দেখবা এই বড় বড় গোশতের টুকরা দেবে।”
শুধু খাওয়ার কষ্ট না–রাজু মাথা নেড়ে বলল, “অন্য ঝামেলাও আছে।”
“কী ঝামেলা?”
“মামার এত বড় বাসা, একলা একলা থাকতে ভয় করে।”
“কিসের ভয়?”
রাজু কিছু বলার আগেই সাগর বলল, “ভূতের।”
রাজু ভেবেছিল সাগরের কথা শুনে আগুনালি হো হো করে হেসে উঠবে, কিন্তু আগুনালি একটুও হাসল না, বরং মুখটা খুব গম্ভীর করে ফেলে বলল, “তা ঠিক, পাহাড়ি জায়গায় ভূতপ্রেতের বড় ঝামেলা। তালতলার পীর এক নম্বর তাবিজ দেন, জিন-ভূতের আবার সাধ্য নাই কাছে আসে। কিন্তু একটা সমস্যা”।
“কী সমস্যা?”
“পীর সাহেব বাচ্চা পোলাপান দেখলে খুব রাগ করেন। শরিফুদ্দি গিয়েছিল গতবার, খড়ম ছুঁড়ে মারলেন। চানদিতে লেগে একেবারে ফাটাফাটি অবস্থা! বড় কাউকে নিয়ে যেতে হবে।” আগুনালি চোখ ছোট ছোট করে চিন্তা করতে করতে অন্যমনস্কভাবে বলল, “একটা উপায় অবশ্যি আছে।”
“কী উপায়?”
“গফুরের একটা তাবিজ আছে–ভাড়া দেয়। ভাড়া নিয়ে আসা যায়। আমি বললে মনে হয় বেশি দরদাম করবে না।”
রাজু অবাক হয়ে আগুনালির দিকে তাকিয়ে রইল। তার বয়সী একটা ছেলে তাবিজ ঝাড়ফুক বিশ্বাস করে, সেই ব্যাপারটাই তার বিশ্বাস হচ্ছে না–এখন সে তাবিজ ভাড়া করার কথা বলছে! তার হঠাৎ হাসি পেয় গেল, কিন্তু সে হাসল না। মুখ গম্ভীর করে বলল, “আমি তাবিজ বিশ্বাস করি না।”
আগুনালি চোখ কপালে তুলে বলল, “বিশ্বাস কর না?”
“না।“
“আমার আপন ফুপাতো বোন, আপন ফুপাতো বোন–”বেশি উত্তেজনায় কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ আগুনালির মুখে কথা আটকে গেল। কয়েকবার চেষ্টা করে হঠাৎ হাল ছেড়ে দিলে পাথরের মতো মুখ করে বলল, “তার মানে তুমি বলতে চাও যে তুমি ভূতও বিশ্বাস কর না?”
রাজু মাথা নাড়ল, “না।”
আগুনালির পাথরের মতো শক্ত মুখ এবার আষাঢ়ের মেঘের মতো কালো হয়ে থমথম করতে লাগল। সে আবার অন্যমস্কের মতো পকেট থেকে একটা ম্যাচ বের করে এবারে একসাথে ছয়টা কাঠি নিয়ে ফস করে আগুন ধরিয়ে নিয়ে সেটার দিকে তাকিয়ে রইল, আগুনটা জ্বলে শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে কাঠিগুলি ধরে রেখে যখন আঙুলে ছ্যাঁকা লাগার অবস্থা হল তখন দূরে ছুঁড়ে ফেলল। তারপর মুখ তুলে রাজুর দিকে তাকিয়ে বলল, “এক লাখ টাকা।”
“এক লাখ টাকা কী?”
“এক লাখ টাকা বাজি।”
“কিসের জন্য?”
“ভূতের জন্য।”
“ভূতের জন্য?”
“হ্যাঁ।”
রাজু ব্যাপারটা কিছুতেই বুঝতে পারল না, “বলল, ভূতের জন্য বাজি মানে। কী?”
“আমি তোমাকে ভূত দেখাব।”
“দেখাতে না পারলে তুমি আমাকে এক লাখ টাকা দেবে?”
“হ্যাঁ, আর দেখাতে পারলে তোমার আমাকে এক লাখ টাকা দিতে হবে।”
রাজু মাথা নাড়ল, “আমার এক লাখ টাকা নেই, কোনোদিন হবেও না।”
“আমারও নাই এক লাখ টাকা।” আগুনালি বাজির দর কমিয়ে আনে, “দশ টাকা বাজি।”
“এক লাখ থেকে একবারে দশ?”
আগুনালি বিরক্ত হয়ে বলল, “টাকাটা তো আর বড় কথা না–বড় কথা হচ্ছে মুখের জবান।”
“তুমি জবান দিচ্ছ যে তুমি আমাকে ভূত দেখাবে?”
“হ্যাঁ।”
“তুমি নিজে দেখেছ ভূত?”
আগুনালি বুকে থাবা দিয়ে বলল, “এই বান্দা কোনো জিনিস নিজে না দেখে মুখ খোলে না।”
‘কীরকম দেখতে?”
“যখন দেখবে তখন জানবে। এই বান্দা আগে থেকে কোনো জিনিস বলে।”
“কোথায় ভূতটা?” আগুনালি আবার বুকে থাবা দিয়ে বলল, “এই বান্দা আগে থেকে কিছু বলবে।”
সাগর খুব অবাক হয়ে দুজনের কথাবার্তা শুনছিল, এবার গলা বাড়িয়ে বলল, “তুমি কি ভূতটা ধরে একটা শিশিতে ভরে দিতে পারবে?”
আগুনালি খানিকক্ষণ হাঁ করে সাগরের দিকে তাকিয়ে রইল, রাজুর মনে হল রেগেমেগে কিছু একটা বলবে, কিন্তু কিছু বলল না। যখন সাগর তার অভ্যাসমতো আবার জিজ্ঞেস করল, তখন মাথা নেড়ে বলল, “না, আমি পারব না।”
“কেন পারবে না? তুমি যদি দেখতে পার তা হলে কেন ধরতে পারবে না?”
“একটা জিনিস দেখা গেলেই সেটা ধরা যায় না। মাছি তো দেখছ, কোনোদিন একটা মাছি ধরতে পেরেছ?”
সাগর এক মুহূর্ত চিন্তা করে বলল, “কিন্তু মশা ধরেছি। মশা ধরা তো অনেক সোজা।”
“ভূত আর মশা এক জিনিস না–”আগুনালি সাগরের সাথে কথায় বেশি সুবিধে করতে পারছিল না বলে রাজুর দিকে তাকিয়ে বলল, “এখন বলো ভূত দেখতে চাও কি না।”
রাজু মাথা চুলকে বলল, “কিন্তু ভাবছিলাম বাসায় ফিরে যাব।”
সাগর মাথা নাড়ল, “না ভাইয়া, চলো ভূতটা দেখে যাই। যদি ধরতে পারি তা হলে আরও মজা হবে।”
আগুনালি বলল, “শুধু ভূত! এখানে কত কী দেখার আছে, দুই মাথাওয়ালা গোরু, মাকড়শা কন্যা, মাটির নিচের গুহা, ঝুলন্ত ব্রিজ, নরবলি মন্দির, মৌনি সাধু–”
“কোথায় সেগুলি?”
“এই তো আশেপাশে। কত দূর দূর থেকে লোকজন দেখতে আসে, আর তুমি এখানে থেকেও না দেখে চলে যেতে চাও? থেকে যাও, আমি সব ব্যবস্থা করে দেব।”
রাজু আগুনালির দিকে তাকিয়ে বলল, “ঠিক আছে। কিন্তু সবার আগে দেখাবে ভূত।”
আগুনালি আবার দাঁত বের করে হাসল, হয় তার দাঁত বেশি, নাহয় অল্পতেই দাঁত বের হয়ে যায়–কিন্তু ছেলেটা মজার তাতে কোনো সন্দেহ নেই।