ছেলেটি এমন গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়তে লাগল যেন সে ভুল করে কাউকে খুন করে ফেলেছে। রাজু কী বলবে বুঝতে পারছিল না, ছেলেটা মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, “তোমরা কিছু মনে নাও নাই তো? বুকেহাত দিয়ে বলো।”
বুকে হাত দিয়ে বললে কী হয় রাজু জানে না, কিন্তু তবু সে বুকে হাত দিয়ে বলল, “না, আমি কিছু মনে নিইনি।”
সাগর অবিশ্যি বুকে হাত দিয়ে কিছু বলতে রাজি হল না। উলটো মুখ শক্ত করে বলল, “আমি আজগর মামাকে বলে দেব, তুমি আমাদের আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিতে চেয়েছ–”
ছেলেটা হাহা করে উঠে বলল, “কী বলছ তুমি? আমি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিতে চেয়েছি? আমি?”
“নয়তো কী? এই যে এটা দিয়ে–”
ছেলেটা সাগরের দিকে হাতের পিচকারির মতো জিনিসটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “দেখো, এইটা শুধু মজা করবার জিনিস।”
“কী এটা?”
“এটার নাম দিয়েছি আগুনি পাখুনি।”
“আগুনি পাখুনি?”
“হ্যাঁ।” ছেলেটা আবার রাজুর দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসল, “এইটা আমার আবিষ্কার, আগুন পাখির মতো উড়াল দিয়া যায় বলে নাম আগুনি পাখুনি। এই যে পিচকারির এইখানে থাকে পেট্রোল, মুখে সিগারেট-লাইটার। ঠিক পিচকারির সময় সিগারেট-লাইটার ফট করে ধরায়ে দিতে হয়, তা হলে ভক করে আগুন জ্বলে ওঠে। এই যে এইভাবে-” বলে কিছু বোঝার আগেই পিচকারি ঠেলে ধরে লাইটার চাপ দিয়ে ছেলেটা বিশাল একটা আগুনের হলকা তৈরি করে ফেলল। রাজু আর সাগর লাফিয়ে পিছনে সরে এল সাথে সাথে।
ছেলেটা মাথা নেড়ে বলে, “ভয়ের কিছু নাই। পাতলা পেট্রোলের আগুনে কোনো তাপ নাই।”
রাজু চোখ বড় বড় করে বলল, “তুমি আগুন দিয়ে খেল?”
ছেলেটা আবার দাঁত বের করে হেসে বলল, “খেলি। আমার আসল নাম ছিল তৈয়ব আলি, এখন সেই নামে আমাকে কেউ চেনে না। এখন সবাই আমাকে ডাকে আগুনালি।”
“আগুনালি?”
“হ্যাঁ, আগুন আলি, তাড়াতাড়ি বললে আগুনালি।”
“সবাই জানে তুমি আগুন নিয়ে খেল? কেউ না করে না?”
“আগে করত, এখন বুঝে গেছে না করে লাভ নাই। এখন আর করে না। তা ছাড়া বুঝে গেছে আমি কারও ক্ষতি করি না। আগুন আমার খুব ভালো লাগে। আগুন ছাড়া আমি থাকতে পারি না–” বলেই তার কথাটা প্রমাণ করার জন্যেই সে ধক করে বিশাল একটা আগুনের হলকা উপরে পাঠিয়ে দিল।
সাগর মুখ হাঁ করে আগুনালির দিকে তাকিয়েছিল। এবার ঢোক গিলে বলল, “তোমার আগুন ভাল লাগে?”
“রসগোল্লার মতো।”
“কাল রাত্রে তুমি এখানে আগুন জ্বালিয়েছিলে?”
“হ্যাঁ, তোমরা দেখেছিলে?” সাগর মাথা নাড়ল, “না, আমি দেখিনি, ভাইয়া দেখেছিল।
আগুনালি উজ্জ্বল মুখে বলল, “ফাস্ট ক্লাস একটা আগুন হয়েছিল। শুকনা কাঠ, কড়কড় করে পোড়ে, শোঁ-শোঁ করে উপরে ওঠে–কী তেজ আগুনে! কিন্তু কোনো উলটাপালটা কাজ নাই। আমার তো দেখে নাচার ইচ্ছা করছিল।”
রাজু মাথা নাড়ল, “আমি দেখেছি তুমি নাচছিলে।”
ছেলেটা একটু লজ্জা পেয়ে গেল। থতমত খেয়ে বলল, “তুমি কেমন করে দেখেছ?”
“বাইনোকুলার দিয়ে।”
“ও! দুরবিন দিয়া? মাস্টার সাহেবের দুরবিন?”
“হ্যাঁ। তুমি যে এত বড় আগুন করেছিলে, যদি সারা পাহাড়ে সেই আগুন ছড়িয়ে যেত?”
“আগুনালি বুকে থাবা দিয়ে বলল, “আমি যেরকম আগুনকে ভালোবাসি আগুনও আমাকে সেইরকম ভালোবাসে। আগুন আমার কথা ছাড়া এক পা নড়ে না।”
“আগুন এক পা নড়ে না?”
“না। এক ড্রাম পেট্রোল রাখো, তার এক হাত দূরে আমি দুই-মানুষ সমান উঁচু আগুন করে দেব, আগুন পেট্রোলকে ছোঁবে না।”
রাজু অবাক হয়ে বলল, “কেমন করে সেটা করবে?”
“আগুনকে বুঝতে হয়। যখন ভালো করে আগুন ধরে তখন গরম বাতাস ওপরে ওঠে। তখন চারপাশ থেকে বাতাস আসে, সেই বাতাসে আগুন নড়েচড়ে। সেই বাতাস দিয়ে বোঝা যায় আগুন কোন দিকে যাবে। তখন ইচ্ছা করলে আগুনকে কন্ট্রোল করা যায়।
“তুমি কন্ট্রোল করতে পার?”
“পারি।” কথা বলতে বলতে আগুনালি অন্যমনস্কভাবে পকেট থেকে একটা ম্যাচ বের করে একসাথে চারটা ম্যাচের কাঠি দিয়ে ফস করে আগুন ধরিয়ে সেটার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল, “আমি আগুন কন্ট্রোল করতে পারি। আজকাল এই এলাকায় যখন আগুন লাগে তখন দমকল বাহিনীকে খবর পাঠাবার আগে আমাকে খবর পাঠায়। দমকল বাহিনী যাবার আগে হাজির হয় এই আগুনালি!”
“তুমি গিয়ে কী কর?”
“আগুনের সাথে কথা বলি।”
“ধুর! আগুনের সাথে আবার কথা বলে কেমন করে?”
আগুনালি আবার দাঁত বের করে হেসে বলল, “সেটা তোমরা বুঝবা না। আলাউদ্দিন ব্যাপারির পাটের গুদামে যখন আগুন লেগেছিল তখন আমাকে ডাকল। গিয়ে দেখি উলটা জায়গায় পানি দিচ্ছে। আমি বললাম, কোনো লাভ নাই, আগুনের তেজ অনেক বেশি দক্ষিণ দিকে বাঁচাতে পারবা না। একটু পরেই পিছন-ঝাঁপটা দেবে, ভুম করে আগুন আকাশে উঠে যাবে। দেখবে তখন আগুন কতদূর যায়! উত্তর দিকে পানি দাও, অন্তত দুইটা গুদাম বাঁচবে। আমার কথা শুনল না, তিনটা গুদাম পুড়ে শেষ।”
কথা বলতে বলতে আগুনালি মুখে লোল টেনে বলল, “আহ্, কী একটা আগুন! লকলক করে উপরে উঠছে, ঠাস-ঠাস করে ফুটছে, দাউদাউ করে জ্বলছে। আর শাই-শাই করে বাতাস–কী দৃশ্য! আহ!”
রাজু আর সাগর অবাক হয়ে আগুনালির দিকে তাকিয়েছিল। আগুনালি হঠাৎ একটু লজ্জা পেয়ে বলল, “এখন তোমাদের কথা বলো। কয়দিন থাকবে এখানে?”
রাজু সাগরের দিকে একবার তাকিয়ে বলল, “মনে হয় আজকেই চলে যাব।”