সাগরের মুখটা হঠাৎ কেমন জানি কাঁদো-কাঁদো হয়ে যায়। কিছুক্ষণ মেঝেতে ফেলা তার থুতুর দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ পা দিয়ে সেটা মেঝেতে লেপটে ফেলে বলল, “কিছু না।”
রাজু গলার স্বর একটু নরম করে বলল, “কী বললি?”
সাগর এবার রাজুর দিকে তাকাল। সত্যি সত্যি গলার স্বর নরম করেছে না কি তাকে টিটকারি করছে বোঝার চেষ্টা করে বলল, আব্বু আর আম্মুর যদি ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় তা হলে কী হবে?”
রাজু হেসে ফেলল, বলল, “ধুর গাধা! ছাড়াছাড়ি কেন হবে?”
সাগর আশান্বিত হয়ে বলল, “ছাড়াছাড়ি হবে না?”
“না।”
“তাহলে এত ঝগড়া করে কেন?”
“পৃথিবীর সব আব্বা-আম্মা ঝগড়াঝাটি করে।”
“সত্যি?”
“সত্যি।”
সাগর হঠাৎ করে খুব খুশি হয়ে ওঠে। রাজু তাকে যত বড় গাধা ভেবে এসেছে সে মনে হয় তত বড় গাধা না। আব্বা-আমার ঝগড়াঝাটিটা যদিও তাদের সামনে করা হয় না, তবুও সে ঠিকই টের পেয়েছে।
সাগর চলে যাবার পর রাজু আবার তার মাথার নিচে হাত দিয়ে আকাশের দিকে তাকাল, এতক্ষণ সে যে-চিলের দিকে তাকিয়ে ছিল সেই চিলটা আর নেই। আকাশে এখন ছোট এক টুকরো সাদা মেঘ। সেই মেঘটা দেখতে একটা জাহাজের মতো। সেই জাহাজটা আবার আস্তে আস্তে একটা প্রাণীর মতো হয়ে যাচ্ছে সেই প্রাণীটার বড় মাথা এবং লম্বা লেজ গজাতে গজাতে হঠাৎ সেটা কয়েকটা টুকরো হয়ে ভেসে গেল। টুকরো টুকরো মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রাজু আবার অন্যমনস্ক হয়ে যায়–তার দুই চোখ কুঁচকে আসে, মুখে একটা যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাকে দেখে মনে হতে থাকে আবার বুঝি তার পেটব্যথা করছে।
তার অবিশ্যি পেটব্যথা করছিল না, কিন্তু ভিতরে ভিতরে হঠাৎ কেমন জানি ভয় ঢুকে গেছে। সাগরকে সে অবিশ্যি অনেক জোর গলায় বলেছে তার আব্বা আম্মার কখনও ছাড়াছাড়ি হবে না, কিন্তু সত্যি যদি হয়ে যায় তখন কী হবে? রাজুর হঠাৎ কেমন জানি গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে, ব্যাপারটা সে চিন্তাও করতে পারে না।
রাজুর আব্বার নাম আজিজুল হক–সবাই অবিশ্যি তাঁকে ডক্টর আজিজ বলে ডাকে। আব্বা অবিশ্যি সত্যিকারের রোগী দেখার ডাক্তার না, অঙ্কে পিএইচ.ডি. করেছেন। মানুষ যখন পিএইচ.ডি. করে তখন তাকে ডক্টর বলে কেন কে জানে, অন্য একটা-কিছু বললেই হয়! মনে হয় সবাইকে একটা ধাঁকার মাঝে ফেলে দেওয়ার একটা বুদ্ধি ছাড়া ব্যাপারটা আর কিছুই না। আব্বা যখন মাঝে মাঝে গ্রামের বাড়িতে যান তখন গ্রামের যত মানুষের রোগ-শোক আছে তারা আব্বার কাছে চিকিৎসার জন্যে চলে আসে। আব্বা যতই তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেন। যে তিনি চিকিৎসা করার ডাক্তার না, তারা কিছুতেই সেটা বিশ্বাস করে না। রাজু আরও একটা ব্যাপার ভালো করে বুঝতে পারে না, সেটা হচ্ছে, মানুষ অঙ্কে কেমন করে পিএইচ.ডি. করে। তখন কি এক মাইল লম্বা একটা সরল অঙ্ক করতে দেওয়া হয়, আর একজন সেটা টুকটুক করে শেষ করে, নাকি অন্যকিছু? রাজু আর আব্বাকে কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছে, আব্বা শুনে হেসেই বাঁচেন না–শেষে বলেছেন, রাজু বড় হলে নাকি বুঝতে পারবে। রাজুর আব্বা ইউনিভার্সিটিতে অঙ্ক পড়ান, তাঁকে দেখতেও ঠিক অঙ্কের প্রফেসরের মতো দেখায়–চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, জুলফির কাছে চুলে পাক ধরেছে। মুখে একটা গম্ভীর ভাব, কিন্তু চোখ দুটি সবসময়েই কেমন যেন হাসিহাসি, একজন মানুষের চোখ হাসিহাসি হয়ে মুখ কেমন করে গম্ভীর হতে পারে রাজু কখনও বুঝতে পারে না।
রাজুর আম্মার নাম ফারহানা হক, শুধু আম্মার অফিসের কেউ-কেউ তাঁকে ডাকে মিসেস ফারহানা হক। অন্য সবাই তাঁকে ডাকে ঝর্না। রাজুর আব্বাও তাকে ডাকেন ঝর্না–সাগর যখন ছোট ছিল সেও ডাকত ঝর্না। রাজুর আম্মা দেখতে একেবারে অসাধারণ–তাঁকে দেখায় কলেজের একটা মেয়ের মতো, তাঁকে দেখে কেউ বুঝতেই পারবে না যে তার তেরো বছরের এত বড় একটা ছেলে আছে। আম্মা যখন অফিসে যান তখন রাস্তাঘাটের সব মানুষ চোখ ট্যারা করে আম্মার দিকে তাকিয়ে থাকে। যারা দেখতে বাড়াবাড়ি সুন্দরী হয় তাদের মেজাজ মনে হয় একটু বেশি গরম হয়–আম্মার মেজাজও বেশ গরম। রাজু কিংবা সাগর যখন ঢ্যাঁড়শ ভর্তা কিংবা করলা ভাজা খেতে না চায় তখন আম্মা এত রেগে যান যে সেটা বলার মতো না। আব্বা মাঝে মাঝে বলেন, “থাক থাক, একদিন না খেলে কিছু হবে না–”আম্মা তখন আরও রেগে গিয়ে বলেন, “তুমি লাই দিয়ে দিয়ে ছেলেগুলির মাথা নষ্ট করেছ। মানুষজন শুধু কাঁচামরিচ আর লবণ দিয়ে ভাত খেয়ে বেঁচে আছে তুমি সেটা জান? এই দেশের কত পার্সেন্ট মানুষ ব্যালেন্সড ডায়েট খায় খবর আছে কারও?”
আম্মা গরিব-দুঃখি মেয়েদের একটা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। যেসব মেয়ের স্বামীরা তাদের বউদের ছেড়ে চলে যায়, কিংবা বাড়ি থেকে বের করে দেয়, বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে কোথাও যাবার জায়গা থাকে না, তারা এখানে এসে থাকে। গরিব-দুঃখি মেয়েদের দেখে দেখে আম্মা নানারকম হিসেব শিখে গেছেন। শতকরা কতজন মানুষ বউদের পেটায়, কতজন মানুষ বউদের ছেড়ে চলে যায়, কতজন যৌতুকের টাকা দেয়নি বলে বউদের মেরে ফেলে–সব হিসেব আম্মার ঠোঁটের ডগায়। দরকার হলেই আম্মা এখন সেসব হিসেব আব্বার উপর, না হয় তাদের উপর ঝাড়তে থাকেন। রাজুর মাঝে মাঝে মনে হয়, আম্মা যদি গরিব দুঃখি মানুষজনের জন্যে কাজ না করে বড়লোকদের বাচ্চাদের কোনো স্কুলে কাজ করতেন তা হলে মন্দ হত না। আম্মা তা হলে জানতেন বড়লোকের বাচ্চাদের কত মজার মজার খেলনা থাকে, তারা কত ভালো জিনিস খায়, ছুটিছাটায় কত দেশ-বিদেশ ঘরে, গাড়ি করে কত সুন্দর সুন্দর জায়গায় বেড়াতে যায়–সে তুলনায় তারা তো কিছুই করে না, কে জানে তা হলে হয়তো আম্মা এক বকাবকি করতেন না।