“কোথায় যাবে?”
“ঐ যে দূরে টিলা দেখা যায় সেখানে।”
“টিলার উপরে?”
“হ্যাঁ।”
“কেমন করে উঠবে?”
“হেঁটে হেঁটে, আবার কীভাবে? উড়ে তো আর যেতে পারব না!”
“টিলার উপরে বাঘ-সিংহ নেই তো?”
রাজু হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো ভঙ্গি করে বলল, “আরে গাধা, আজকাল সুন্দরবনে বাঘ-সিংহ নেই!”
“কোথায় গেছে বাঘ-সিংহ?”
রাজু মুখ ভেংচে বলল, “পিএইচ. ডি. করতে আমেরিকা গেছে। গাধা কোথাকার–এত কথা কিসের! যেতে চাইলে আয়, না হলে থাক।”
“যেতে চাই না। সাগর মুখ বাঁকা করে বলল, তোমার সাথে আমি কোথাও যেতে চাই না।”
রাজু অবিশ্যি সাগরকে একা একা ফেলে রেখে যাচ্ছিল না, তাই গলা নরম করে বলল, “ঠিক আছে, যদি না যেতে চাস তা হলে একলা একলা থাক এখানে। আর যদি আমার সাথে যাস তা হলে তোকে বলব কাল রাত্রে তুই যখন ঘুমাচ্ছিলি তখন আমি কী দেখেছিলাম।”
সাথে সাথে সাগর কৌতূহলী হয়ে উঠল, “কী দেখেছিলে?”
“ঐ টিলার উপরে দাউদাউ আগুন আর তার সামনে তান্ত্রিক সন্ন্যাসী হাতে নরমুণ্ড নিয়ে নাচছে।”
“সত্যি?”
“সত্যি। স্পষ্ট দেখা যায়নি, তবু সেরকমই মনে হল। মামার বাইনোকুলার দিয়ে দেখেছি। তান্ত্রিক সন্ন্যাসী অবশ্য সাইজে বেশি বড় না। ছোটখাটো–”
“আমাকে ডাকলে না কেন? আমি দেখতাম–”
“হ্যাঁ! রাজু নাক দিয়ে তাচ্ছিল্যের মতো একটা শব্দ করে বলল, তোকে ডেকে তুলব! তা হলেই হয়েছে! তুই যখন ঘুমাস কার সাধ্যি আছে তোকে ডেকে তোলে! এখন যদি দেখতে চাস তা হলে চলে–”
সাগর উৎসাহে উঠে দাঁড়াল, বলল, “চলো যাই। কিন্তু আমাদের কিছু করবে না তো?”
“ধুর! কী করবে? দিনের বেলা ফটফটে আলো, রোদ–এর মাঝে সন্ন্যাসীরা কিছু করে না। সন্ন্যাসীদের সব কাজকারবার রাত্রের অন্ধকারে।”
কিছুক্ষণের মাঝে সাগর আর রাজু মামার বাসার পিছনের মেঠো পথ দিয়ে হেঁটে হেঁটে টিলার দিকে যেতে থাকে। কী সুন্দর একটা দিন, চারিদিকে ঝকঝক করছে আয়নার মতো। রোদটা কী চমৎকার! একটুও গরম না, কী সুন্দর মিষ্টি মিষ্টি ঠাণ্ডা একটা ভাব–এর মাঝে হাঁটলে সারা শরীরে কেমন জানি আরাম লাগতে থাকে। রাজু আর সাগর হেঁটে হেঁটে গাছগাছালির মাঝে দিয়ে ছোট একটা খাল পার হয়ে টিলার উপর উঠতে থাকে। রাজু বাইরে খুব সাহস দেখালেও তার ভিতরে ভিতরে একটু ভয়-ভয় করছিল। কাল রাতেই সেই বিচিত্র ছেলেটা যদি এখনও থাকে?
টিলার উপরে উঠে অবিশ্যি রাজুর ভয় কেটে গেল, কেউ কোথাও নেই। উপরে ফাঁকা জায়গাটাতে, যেখানে কাল রাতে আগুন জ্বলছিল–কিছু পোড়া কাঠ আর ছাই পড়ে আছে। চারপাশে গাছগাছালির উপর কেউ-একজন নেচেকুঁদে পুরো জায়গাটাকে সমান করে ফেলেছে। রাজু যখন নিচু হয়ে জায়গাটা ভালো করে দেখার চেষ্টাটা করছিল ঠিক তখন কে যেন চিকন গলায় চিৎকার করে উঠল, “আ-গুন-গুন-গুন আগুন-গুন …”
রাজু চমকে উঠে দাঁড়াল, সাগর ভয় পেয়ে ছুটে এল রাজুর কাছে, আর ঠিক তখন তাদের ডান পাশ দিয়ে সরসর করে আগুনের একটা হলকা ছুটে গেল। রাজু আর সাগর একসাথে চিৎকার করে উঠে একজন আরেকজনকে ধরে সামনে তাকাল, দেখল ঠিক তাদের সামনে কালোমতন একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে, মাথায় একটা লাল ফিতা বাঁধা। ছেলেটার হাতে পিচকারির মতো কী-একটা জিনিস, আগুনটা সেখানে থেকেই বের হয়েছে।
ছেলেটা তাদের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হেসে আবার চিকন গলায় চিৎকার করে বলল, “খা খা খা, আগুন ধইরা খা!”
সাথে সাথে আরেকটা আগুনের হলকা তাদের গা-ঘেঁষে ছুটে গেল। রাজু কী করবে বুঝতে পারছিল না, শক্ত করে সাগরের হাত ধরে রেখে জোর করে গলায় জোর এনে বলল, “কে? কে তুমি? কী চাও?”
ছেলেটা হঠাৎ হি হি করে হাসতে থাকে, যেন খুব মজার একটা ব্যাপার হয়েছে। হাসতে হাসতেই কাছে এসে গলা নামিয়ে বলল, “ভয় পেয়েছ?”
রাজুর বুকের ভিতর তখনও ধকধক করে শব্দ করছে, সাগর তো প্রায় কেঁদেই দিয়েছে। কোনো কথা না বলে রাজু অবাক হয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইল। কালো প্যান্ট আর বোতাম খোলা একটা রংচঙে শার্ট পরে আছে। খালি পা ধুলায় ধূসর, মাথার এলোমেলো চুল একটা লাল কাপড় দিয়ে বাঁধা। ছেলেটা পিচিক করে থুতু ফেলে বলল, “হঠাৎ দেখে মজা করার শখ হল।”
রাজু কোনো কথা না বলে ছেলেটার দিকে এবং তার হাতের বিচিত্র জিনিসটার দিকে তাকিয়ে রইল। ছেলেটা রাজুর হতচকিত ভাব দেখে খুব আনন্দ পেল বলে মনে হল। একগাল হেসে বলল, “ভয়ের কিছু নাই। এইটা মজা করার মেশিন। তোমার বাড়ি কই?” আগে তো দেখি নাই।”
রাজু শেষ পর্যন্ত কথা বলার মতো একটু জোর পেল, নিঃশ্বাস ফেল বলল, “আমি এখানে থাকি না। বেড়াতে এসেছি মামার কাছে।”
“কে তোমার মামা?”
টিলার ওপর থেকে দূরে আজগর মামার ছবির মতো বাসাটা দেখা যাচ্ছিল। রাজু হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল, “ঐ যে আজগর মামার বাসা।”
ছেলেটার চোখগুলি হঠাৎ গোল গোল হয়ে গেল। মুখ দিয়ে শিস দেওয়ার মতো শব্দ করে বলল, “তুমি মাস্টার সাহেবের ভাগনা?”
আজগর মামা কোনো স্কুল-কলেজে পড়ান না, তাকে কেন মাস্টার বলছে রাজু বুঝতে পারল না। অন্য কারও সাথে গোলমাল করেছে কি না সন্দেহ হচ্ছিল, কিন্তু ছেলেটার পরের কথা শুনে তার সন্দেহ দূর হয়ে গেল। ছেলেটা মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “আজগর স্যার আমাদের সবার মাস্টার সাহেব–একেবারে ফিরিশতা কিসিমের মানুষ। তার ভাগনা তোমরাও তো আধা–ফিরিশতা। তোমাদের ভয় দেখানো ঠিক হয় নাই। একেবারেই ঠিক হয় নাই।”