রাজু বিছানায় পা তুলে বসে রইল। বুকের ভিতর ধকধক করে শব্দ করছে, কী ভয়টাই-না সে পেয়েছিল! সাগর এখনও ঘুমিয়ে আছে, মুখটা একটু খোলা নিঃশ্বাসের সাথে সাথে ঠোঁট নড়ছে একটু একটু।
রাজু বিছানা থেকে নেমে এল। দরজা-জানালা বন্ধ করে মশারি টানাতে হবে। খুব বেশি মশা নেই, একটা-দুটা পিনপিন শব্দ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে–তারা বাইরে গিয়ে হয়তো খবর দেবে অন্যদের। রাজু জানালার কাছে দাঁড়ায়, বাইরে অন্ধকার, তার মাঝে দমকা বাতাস। গাছের পাতা নড়ছে, ঝিঁঝি পোকা ডাকছে, হঠাৎ কেন জানি মন-খারাপ হয়ে গেল রাজুর।
জানালা বন্ধ করতে গিয়ে হঠাৎ রাজু থমকে দাঁড়াল, দূরে টিলার উপর দাউদাউ আগুন জ্বলছে। কী আশ্চর্য, এই গভীর রাতে নির্জন টিলার উপরে আগুন জ্বলছে কেন! কে জ্বালিয়েছে আগুন? রাজুর হঠাৎ কেমন জানি ভয় লাগতে থাকে।
ভালো করে তাকাল সে, অনেক দূরে ভালো করে দেখা যায় না কিছু, মনে হচ্ছে আগুনের সামনে কিছু একটা নড়ছে–কোনো মানুষ আছে ওখানে! কীরকম মানুষ–এত রাতে টিলার উপরে আগুন জ্বালিয়েছে। মামা যে বলেছিলেন নরবলি দেয় তান্ত্রিক সাধুরা সেরকম কোনো মানুষ নাকি? নরবলি কি দিচ্ছে টিলার উপরে?
রাজু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল, আর ঠিক তখন তার বাইনোকুলারটার কথা মনে পড়ল। সে ছুটে গিয়ে শেলফের ওপর থেকে এনে বাইনোকুলারটা চোখে লাগায়, ফোকাস করতেই হঠাৎ আগুনটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, দাউদাউ করে বিশাল একটা আগুন জ্বলছে আর তার সামনে মানুষ নয়, বাচ্চা একটা ছেলে। ঠিক তার বয়সী ছেলেটার মাথায় লাল একটা ফিতা বাঁধা, খালি গা, হাতে ঢোলের মতো কিছু-একটা জিনিস। আগুনটা ঘিরে ঘিরে সে নাচছে, কিছু-একটা বলছে আর হঠাৎ করে কিছু-একটা ছুঁড়ে দিচ্ছে আগুনের দিকে সাথে সাথে দাউদাউ করে আগুনটা বেড়ে যাচ্ছে অনেক গুণ।
মাথা দুলিয়ে শরীর ঝাঁকিয়ে অঙ্গভঙ্গি করে ছেলেটা নেচে যাচ্ছে আর নেচে যাচ্ছে, যেন তার উপর কোনো প্রেতাত্মা এসে ভর করেছে অদৃশ্য জগৎ থেকে। ছেলেটা চিৎকার করছে, কথা বলছে আর আগুনটা বেড়ে যাচ্ছে। মনে হয় কিছুক্ষণেই এই আগুন গ্রাস করে ফেলবে চারদিক।
রাজু হতবাক হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল।
৪. চতুর্থ দিন
রাজুর রাত্রে ঘুমাতে অনেক দেরি হয়েছিল, সকালে উঠতেও অনেক দেরি হল। ঘুম থেকে উঠে দেখে সাগর বারান্দায় একটা মুড়ির টিন নিয়ে বসে চিবিয়ে চিবিয়ে মুড়ি খাচ্ছে। রাজুকে দেখে বলল, “আমি আর জন্মেও মামার সাথে কথা বলব না।”
“কেন?”
“মামা আমাদের এখানে এনে নিজে চলে গেছে। বলেছে চান মিয়া আসবে, সেও আসেনি। কোনোকিছুর ঠিক নেই মামার–”
রাজু মামার পক্ষ টেনে একটু কথা বলার চেষ্টা করল, “কী করবে মামা, হঠাৎ করে যেতে হল!”
সাগর মুখ শক্ত করে মাথা নাড়ল, “না, মামা খুব ভুল কাজ করেছে। আমি মামাকে সেজন্য শাস্তি দেব, কঠিন শাস্তি।”
“শাস্তি দিবি? তুই?”
“হ্যাঁ।”
“কী শাস্তি দিবি?”
“এখনও ঠিক করিনি, চিন্তা করছি। একটা হতে পারে মামার যত বই আছে সবগুলি ছিঁড়ে ফেলা–”
রাজু চোখ কপালে তুলে বলল, “কী বলছিস তুই, মাথা-খারাপ হয়েছে?”
সাগর মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ, মামার সবগুলি বই যদি ছিঁড়ে ফেলে দিই তা হলে মামার উচিত শাস্তি হবে। তা হলে মামা আর জন্মেও আমাদের ফেলে রেখে চলে যাবে না–”
রাজু একটু এগিয়ে বলল, “দেখ, তুই ওসব কিছু করিস না। মামাকে শাস্তি দিতে চাস ভালো কথা, এমনভাবে দে যেন কোনো ক্ষতি না হয়”
“সেটা আবার কী রকম?”
রাজু মাথা চুলকে বলল, “যেমন মনে কর মামার তেলের বোতলে কালি ভরে রাখলাম, মামা যেই গোসল করে এসে মাথায় তেল দেবে কালিতে সারা মুখ মাখামাখি হয়ে যাবে”
ব্যাপারটা চিন্তা করে মুহূর্তে সাগরের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। দাঁত বের করে হেসে বলল, “হ্যাঁ, তা হলে মামার উচিত শাস্তি হবে। উচিত শাস্তি!–”
“তারপর মনে কর মামার যে চিনির বয়াম আছে সেখানে লবণ ভরে রাখলাম। মামা যখন রাত্রে চা বানিয়ে খাবে তখন চা মুখে দিয়েই থু থু করে উঠবে—”
সাগর এবার আনন্দে হেসে ফেলে বলল, “উচিত শাস্তি, উচিত শাস্তি!”
“তারপর মনে কর মামার যে টুথপেস্ট আছে সেটা পিছন থেকে খুলে সব টুথপেস্ট বের করে ভিতরে আমাদের ল্যাদাল্যাদা খিচুড়ি ভরে রাখতে পারি। মামা এসে যেই টুথপেস্ট টিপে ধরবে পিচিক করে হলুদ রঙের খিচুড়ি বের হয়ে আসবে–”
সাগর এবারে হাততালি দিয়ে মাথা নাড়তে থাকে। রাজু বলল, “আগেই বই-টই ছিঁড়িস না।”
রাজু হাতমুখ ধুয়ে এসে সাগরের পাশে বসে মুড়ি খেতে থাকে। মুড়ি জিনিসটা খেতে খারাপ না, কিন্তু এটা কখন খাওয়া বন্ধ করতে হবে বোঝা যায় না। অল্প কিছু মুড়ি নিয়ে বসলে একসময় সেটা শেষ হলে খাওয়া বন্ধ করা যায়। কিন্তু সাগর খুঁজে খুঁজে আস্ত মুড়ির টিন বের করে এনেছে। রাজু মুড়ি খেতে খেতে বলল, “আজকের দিনটা দেখব। যদি মামা না আসে কিংবা চান মিয়া না আসে তা হলে বাসায় চলে যাব।”
সাগর গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়ল, হ্যাঁ চলে যাব। মামার সবগুলি শাস্তি রেডি করে বাসায় চলে যাব।”
রাজু মুড়ি খেতে খেতে দূরে টিলার দিকে তাকাল–কাল রাতে সেখানে কী ভয়ানক দাউদাউ করে আগুন জ্বলছিল, আর কী আশ্চর্যভাবে একটা ছেলে নেচে যাচ্ছিল। রাত্রিবেলা সেটা দেখে তার কী ভয়টাই না লেগেছিল, অথচ এখন ব্যাপারটাকে মোটেও সেরকম ভয়ের মনে হচ্ছে না, বরং মজার একটা জিনিস বলে মনে হচ্ছে। সত্যি কথা বলতে কি, জায়গাটা গিয়ে একবার দেখে আসতে ইচ্ছে করছে। রাজু সাগরের দিকে তাকিয়ে বলল, “চল সাগর ঘুরে আসি।”