“খাব কী?”
“আমাদের কাছে টাকা আছে না? বাজারে গিয়ে হোটেলে খাব। হোটেলে মানুষ খায় না?”
সাগর একটু অবাক হয়ে রাজু দিকে তাকাল। রাজু গলার জোর দিয়ে বলল, “বাজার থেকে চাল-ডাল কিনে আনব, তারপর নিজেরা রান্না করে খাব। পিকনিকের মতো হবে।”
“রাত্রে?”
“রাত্রে কী?”
“রাত্রে যদি ভয় লাগে?”
“ভয়? রাজু অবাক হবার ভান করে বলল, “কিসের ভয়?”
“ভূতের।”
“ধুর!” রাজু হাত দিয়ে পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দেবার ভান করে বলল, “ভূত বলে আবার কিছু আছে নাকি!”
“যদি রাত্রে ডাকাত আসে?”
“ডাকাত?”
“হ্যাঁ।”
“মামার বন্দুক আছে না? বন্দুক মাথার কাছে রেখে ঘুমাব।”
সাগর চিন্তিত মুখে বলল, “কিন্তু মামা যে বন্দুকটা ধরতে না করেছে?”
“আমরা তো আর ব্যবহার করছি না, শুধু মাথার কাছে রাখছি।”
এই প্রথম সাগরের মুখে একটু হাসি ফুটে উঠল। চোখ মুছে বলল, “আমার মাথার কাছে রাখব। ঠিক আছে?”
“ঠিক আছে। রাজু নরম গলায় বলল, “চল, এখন দেখি রান্নাঘরে খাওয়ার কিছু আছে কিনা। যদি থাকে তা হলে আজ রাতে আর বের হব না।”
রান্নাঘরে চাল, ডাল, তেল, মশলা, বাসনকোসন, থালা, চামচ সবকিছু খুঁজে পাওয়া গেল। শুধু তা-ই না, একটা ঝুড়িতে কিছু আলু, কিছু শুকনো ঢ্যাঁড়শ এবং কয়েকটা মাঝারি আকারের ডিমও রয়ে গেছে। একনজর দেখে রাজু হাতে কিল দিয়ে বলল, “চল রান্না করে ফেলি।”
সাগর ভয়ে-ভয়ে বলল, “তুমি রান্না করতে পার?”
“না পারার কী আছে?”
“কী রান্না করবে?”
“খিচুড়ি আর ডিমভাজা।”
সাগর চোখ বড় বড় করে বলল, “তুমি জান খিচুড়ি কেমন করে রান্না করতে হয়?”
“একশো বার জানি। খিচুড়ি রান্না হচ্ছে সবচেয়ে সহজ। চাল ডাল তেল মশলা লবণ সবকিছু মিশিয়ে আগুনে গরম করলে খিচুড়ি হয়ে যায়। যদি ল্যাদলেদে থেকে যায় সেটার নাম হয় নরম খিচুড়ি যদি শুকিয়ে যায় তা হলে বলে ভুনা খিচুড়ি।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ, তুই খালি দ্যাখ।”
রাজু সত্যি সত্যি বাসনকোসন টানাটানি করে রান্না শুরু করে দেয়।
রান্নার এই প্রজেক্টটি পুরোপুরি শেষ হতে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লেগে গেল। এই সময়ের বেশির ভাগ অবিশ্যি লেগেছে চুলোর আগুন সামলাতে, বাসনকোসন বের করে সেগুলি ধোয়াধুয়ি করতে আর পেঁয়াজ মরিচ কাটাকাটি করতে। রান্নার পর খেতে সময় লাগল খুব কম। রাজু এবং সাগর দুজনেই খুব অবাক হয়ে গেল যখন তারা আবিষ্কার করল তাদের রান্না হয়েছে চমৎকার, তবে আন্দাজ না থাকায় যে-পরিমাণ খিচুড়ি রান্না হয়েছে সেটা হেসে খেলে প্রায় এ-সপ্তাহ খেলেও শেষ হবে বলে মনে হয় না। খিচুড়িতে আরও একটা ছোট রহস্য রয়ে গেছে, এর উপরের ইঞ্চি দুয়েক ভুনা খিচুড়ির মতো হলেও নিচের প্রায় একফুট ল্যাদলেদে রয়ে গেছে। ডিমভাজার মাঝে অবিশ্যি কোনো খুঁত নেই। চোখ বন্ধ করে পাকা বাবুর্চির কাজ হিসাবে চালিয়ে দেওয়া যায়।
খাওয়ার পর দুজনেরই মন একটু ভালো হয়ে যায়। তখন তারা মামার বাসায় কী কী আছে পরীক্ষা করে দেখতে শুরু করল। শেলফের উপরে মামার বাইনোকুলারটা পাওয়া গেল। বাইরে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার, আকাশে চাঁদও নেই–তাই সেটা দিয়ে কিছু দেখা গেল না। বইয়ের আলমারিতে অনেক বই, তবে বেশির ভাগই পড়ার অযোগ্য–ছোট ছোট ছাপাতে ইংরেজি লেখা। খোজাখুঁজি করে কিছু বাচ্চাদের বই পাওয়া গেল, তবে বেশ পুরনো। অনেকগুলি গানের ক্যাসেট, তবে বেশির ভাগই খুব ঢিলে ধরনের গান, খুঁজে খুঁজে কয়েকটা তালের ইংরেজি গান বের করে সেটাই লাগিয়ে দিল। ভলিউম বাড়িয়ে দেবার পর ঘরে বেশ উৎসব-উৎসব ভাব এসে পড়ে। মামার বন্দুকটাও পাওয়া গেল, তবে সেটা আলমারির মাঝে তালা মারা, আশেপাশে কোনো ছবিও নেই। যন্ত্রপাতির একটা বড় বাক্সও পাওয়া গেল, তার মাঝে রাজ্যের ক্রু নাট বল্টু আর যন্ত্রপাতি।
রাজু আর সাগর দুটা বই নিয়ে এসে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে। ঘরে ইংরেজি গান হচ্ছে, কিন্তু দুজনেই কান খাড়া করে রেখেছে হঠাৎ করে যদি চান মিয়া এসে হাজির হয়!
বিছানায় হেলান দিয়ে বসে বই পড়ার একটা ছোট অসুবিধে আছে, সহজেই ঘুম পেয়ে যায়। সাগরের বইটি ছিল একটু নীরস ধরনের, কাজেই প্রথমে সে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম জিনিসটা বাড়াবাড়ি সংক্রামক, তাই কিছুক্ষণের মাঝে রাজুর চোখের পাতাও ভারী হলে এল। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল, দুজন একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে।
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে রাজু বিচিত্র সব স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নগুলি ঠিক দুঃস্বপ্ন নয়, কিন্তু দুঃস্বপ্নের মতোই। সে দেখল, কারা যেন আম্মা আর আব্বাকে ট্রেনের মাঝে দরজা বন্ধ করে কোথায় জানি নিয়ে যাচ্ছে, রাজু চিৎকার করে ডাকছে, কিন্তু কেউ তার কথা শুনছে না। রাজু চান মিয়াকেও স্বপ্নে দেখল, বসে বসে পরোটা তৈরি করেছে, কিন্তু যতবার পরোটা তৈরি করা হয় ততবার সেগুলি ছোট ছোট জম্ভর মতো ঘরের মাঝে ঘুরে বেড়াতে থাকে। তারপর সে স্বপ্নে দেখল খবিবুর রহমানকে। বিশাল রামদা হাতে নিয়ে সে লাফঝাঁপ দিচ্ছে। তার মুখে বড় দাড়ি, চোখ লাল আর হাতে বিশাল একটা রামদা। তার সাদা পাঞ্জাবিতে রক্তের ছিটা। সে রামদা হাতে নিয়ে লাফাচ্ছে আর ছোট ছোট বাচ্চা মেয়েদের দেখলেই তার পিছুপিছু ছুটে যাচ্ছে। একসময় খবিবুর রহমান রাজুকে দেখে ফেলল, তখন রামদা হাতে নিয়ে তার দিকে ছুটে এল, কিন্তু তার কাছে না এসে দরজার চৌকাঠে কোপাতে শুরু করল। খটখট শব্দ হচ্ছে আর সে পান-খাওয়া লাল দাঁত বের করে হাসছে–আর ঠিক তখন ঘুম ভেঙে গেল রাজুর। দেখল সত্যিই দরজায় সাদা পাঞ্জাবি পরা একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, মানুষটা নড়ে উঠল আর খটখট করে শব্দ হল চৌকাঠে। ভয়ে আতঙ্কে চিৎকার করতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিল রাজু, মানুষ নয়, দরজায় পর্দা ঝুলছে, বাতাসে নড়ে উঠে দরজা জানালা খটখট করে শব্দ করছে।