রাজু সাগরের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই সুন্দর কী জানিস না?
“জানব না কেন?”
“তা হলে এটা সুন্দর লাগছে না?”
“না।“ সাগর পা দাপিয়ে বলল, “আমি এখানে থাকব না।”
রাজুর ইচ্ছে করল সাগরের চুলের মুঠি ধরে তাকে একবার পুকুরের পানি থেকে চুবিয়ে আনে, কিন্তু দুজনে কেউই সাঁতার জানে না–ব্যাপারটা সহজ নয়। সে শুধু চোখ পাকিয়ে সাগরের দিকে তাকাল, দেখল, সাগর ঠোঁট উলটিয়ে কাদার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। রাজু উদাস গলায় সাগরের দিকে তাকিয়ে বলল, “এখন থামোকা কাঁদিস না, তোর কান্না শুনে কেউ তোকে দেখতে আসবে না।”
কথাটাতে ম্যাজিকের মতো কাজ হল, মুহর্তে সাগরের কান্না-কান্না ভাব দূর হয়ে গিয়ে সেখানে ভয়ের একটা ভাব ফুটে ওঠে। ঢোক গিয়ে শুকনো গলায় বলল, “বাসায় যাব।”
“ঠিক আছে, যাব। একটু বসে যাই, বাসায় গিয়ে তো বসেই থাকবি।”
আশ্চর্য ব্যাপার, সাগর মাথা নেড়ে রাজি হয়ে রাজুর পাশে বসে পড়ে! রাজু তখন হেলান দিয়ে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে যায়। কিছুক্ষণের মাঝেই তার মুখ দেখে মনে হতে থাকে তার পেটব্যাথা করছে।
রাজু আর সাগর যখন বাসায় ফিরে এল তখন বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। এতক্ষণে চান মিয়া নিশ্চয়ই এসে গেছে। তার কাছে রান্নাঘরের চাবি থাকে। সে নিশ্চয়ই এসে এতক্ষণে বেহেশতি পরোটা আর শিককাবাব তৈরি করে ফেলেছে। কিংবা কে জানে হয়তো ভুনা খিচুড়ি। মামা কোনটার কথা বলেছেন কে জানে! সে নাকি খুব ভাল কুলপি বরফ তৈরি করে, আইসক্রিমের মতো খেতে, কে জানে আজকে তৈরি করবে কি না! যদি তৈরি করে তা হলে সে একসাথে দুটি বাটি খেয়ে ফেলবে।
আজগর মামার বাসায় এসে পৌঁছানোর আগেই হঠাৎ করে রাজুর দুটি জিনিস মনে হয়, অনেকটা দৈববাণীর মতো। তার মনে হল চান মিয়া এখনও আসেনি এবং চান মিয়া আর আসবে না। কেন এটা তার মনে হল সে জানে না, কিন্তু ব্যাপার দুটি নিয়ে তার মনের ভিতরে আর এতটুকু সন্দেহ রইল না।
কাজেই বাসায় পৌঁছে যখন তারা আবিষ্কার করল পুরো বাসাটিতে থমথমে অন্ধকার এবং রান্নাঘরে তালা ঝুলছে, রাজুও একটুও অবাক হল না। সাগর কিন্তু ব্যাপারটি যেন ঠিক বুঝতে পারল না, কেমন যেন রেগে উঠে বলল, “চান মিয়া এখনও আসেনি?”
রাজু কোনো উত্তর দিল না, হঠাৎ কেন জানি তার একটু ভয়-ভয় লাগতে শুরু করেছে।
“আমরা খাব কেমন করে?” রাজু এবারেও কোনো উত্তর দিল না, দূরে তাকিয়ে রইল।”ঘুমাব কেমন করে?”
রাজু তখনও কোনো কথা বলল না, মুখে শুধু চিন্তার একটা ছাপ স্পষ্ট হয়ে এল। ঠিক তখন সাগর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল।
একেকজন মানুষের কান্নার ধরন একেক রকম, সে-হিসেবে সাগরের কান্নার ধরনটি খুব বিচিত্র। সে প্রথমে হাউমাউ করে একচোট কেঁদে নেয়, তারপর তার কান্নার দমকটা একটু কমে আসে, তখন সে কাঁদতে কাঁদতে নানারকম কথা বলতে শুরু করে। এমনিতে সে গুছিয়ে কথা বলতে পারে না, কিন্তু কাঁদতে কাঁদতে সে খুব গুছিয়ে সুন্দর করে কথা বলে। মনের ভাবটা সে খুব সুন্দর করে প্রকাশ করে।
রাজু ধৈর্য ধরে সাগরের কান্নার প্রথম পর্ব শেষ হয়ে দ্বিতীয় পর্ব শুরু হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে এবং দেখতে দেখতে সেটা শুরু হয়ে গেল। সাগর কাঁদতে কাঁদতে বলতে শুরু করল যে, আজগর মামার এই বাসাটা একটা জঙ্গল ছাড়া আর কিছু না, তাদের এখানে আসাই ভুল হয়েছে। আজগর মামা তাদেরকে একা একা ফেলে চলে গিয়ে খুব ভুল করেছেন, কারণ, তারা এখন কয়েকদিনের মাঝে না খেয়ে মারা যাবে। একটু স্কুল ভেঙে ফেললে কী হয়–সেটা আবার তৈরি করা যায়, কিন্তু কেউ মরে গেলে তাদেরকে কি আবার বাঁচিয়ে তোলা যায়? যায় না। বন্দুকটা তার ধরা নিষেধ, পুকুরে মাছ ধরতেও যেতে পারবে না। বাসাতে কোনো খেলনা নেই, আলমারিতে যে-বইগুলি আছে তার কোনোটাতে ছবি নেই–সেইসব বই থাকলেই কী আর না থাকলেই কী? এই বাসায় থেকে তাদের কী লাভ? এই মুহূর্তে তাদের আব্বা-আম্মার কাছে চলে যাওয়া উচিত। তাদের যেরকম কপাল, গিয়ে দেখবে আব্বা-আম্মা ঝগড়া করে করে শেষ পর্যন্ত তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। তখন তারা কোথায় যাবে? এর থেকে তো মরে যাওয়াই ভালো, তা হলে সে মরে যাচ্ছে না কেন? খোদা কেন শুধুমাত্র কষ্ট দেওয়ার জন্যে তাদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছেন? ইত্যাদি ইত্যাদি…
রাজু প্রথম দিকে সাগরের কান্না আর কথাবার্তাকে বেশি গুরুত্ব দেয়নি, কিন্তু শেষের দিকে যখন আব্বা-আম্মার কথা বলতে শুরু করল তখন হঠাৎ করে তার নিজেরও মন-খারাপ হয়ে গেল। তখন সে জীবনেও যেটা করেনি সেটা করে ফেলল, সাগরকে ধরে নরম গলায় বলল, “ধুর বোকা ছেলে! কাঁদিস কেন? কাঁদার কী হয়েছে?”
সাগর সাথে সাথে কান্না থামিয়ে অবাক এবং সন্দেহের চোখে রাজুর দিকে তাকাল, রাজু তার সারাজীবনে কয়বার তার সাথে নরম গলায় কথা বলেছে সেটা আঙুলে গুনে ফেলা যায়। সাগর ভুরু কুঁচকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল রাজু সত্যিই তার সাথে নরম গলায় কথা বলছে নাকি অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে। যখন দেখল অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই তখন সে আরও জোরে ভেউভেউ কর কাঁদতে শুরু করল।
ঠিক কী কারণ বুঝতে পারল না, কিন্তু সাগরের কান্না দেখে রাজুর নিজের চোখেও হঠাৎ পানি এসে গেল। সাবধানে সে চোখ মুছে সাগরের পিঠে হাত রেখে বলল, “কাদার কী আছে, দুইদিন একা থাকতে হলে থাকব।”