“সত্যি?” মামা উজ্জ্বল চোখে বললেন, “সত্যি পারবি?”
“কেন পারব না? একশোবার পারব।”
সাগর সাধারণত উলটোপালটা কথা বলে, এবারে কী হল কে জানে, সে মাথা নেড়ে বলল, “পারব মামা, কোনো অসুবিধে নেই।”
মামার চেহারায় তবু কেমন জানি একটু অপরাধী-অপরাধী ভাব রয়ে গেল। সেভাবেই বললেন, “চান মিয়া আজ রাতের মাঝে এসে যাবে। সে খুব কাজের মানুষ, একেবারে নিজের ঘরের মানুষের মতো। সে এসে গেলে তোদের আর কোনো অসুবিধা হবে না, দেখিস কী চমৎকার রান্না করবে!”
রাজুর মামার জন্যে খুব মায়া লাগল, বলল, “তুমি চিন্তা কোরো না মামা, আমাদের কোনো অসুবিধা হবে না। তুমি গিয়ে স্কুলটাকেও বাঁচাও।”
মামা বললেন, “বাঁচাব। দেখিস, স্কুলটাকে ঠিকই বাঁচাব।”
উপস্থিত সব মানুষ তখন জোরে জোরে মাথা নাড়াল। মামা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “ড্রয়ারের মাঝে বইয়ের আলমারির চাবি আছে, চান মিয়াকে বলিস, খুলে দেবে।”
“বলব।”
“শেলফের উপর দেখিস একটা বাইনোকুলার আছে, রাত্রিবেলা সেটা দিয়ে আকাশে চাঁদ দেখতে পারবি।”
“ঠিক আছে মামা?”
“গানের ক্যাসেট আছে অনেক। যত জোরে ইচ্ছে গান শুনতে পারিস, আশেপাশে কেউ নেই, কেউ এসে নালিশ করবে না।”
সাগর বলল, “তোমার বন্দুকটা দিয়ে খেলতে পারি মামা?” মামা চোখ কপালে তুলে বললেন, “কী বললি বন্দুক?”
“হ্যাঁ।”
“মাথা খারাপ হয়েছে তোর? বন্দুক কি একটা খেলার জিনিস হল?” সাগর ভুরু কুঁচকে বলল, “তা হলে রাজু যে মোটর-সাইকেল চালাল?”
মামা মাথা নেড়ে বললেন, “সে তো আমার সামনে চালিয়েছে। আমি না থাকলে রাজুকে মোটর সাইকেল ছুঁতে দেব?”
“দেবে না মামা?”
“না।” শুনে সাগর খুব খুশি হয়ে দুলে দুলে হাসতে লাগল।
মামা বললেন, “আমি ঘুরে আসি, তারপর সবরকম অ্যাডভেঞ্চার শুরু হবে। এখন বই পড়িস, গান শুনিস, ইচ্ছে হলে পিছনে পুকুর আছে–যেখানে মাছ ধরতে পারিস। মাঝারি সাইজের রুইমাছ আছে। চান মিয়াকে বলিস ছিপ বের করে দেবে। সাঁতার জানিস তো?”
রাজু মাথা নাড়ল, “না মামা।”
মামা চোখ কপালে তুলে বললেন, “তা হলে খবরদার পুকুরের ধারে কাছে। যাবি না। মাছ ধরার দরকার নেই। ঠিক আছে? মনে থাকবে তো?”
মনে থাকবে।”পিছনে টিলা আছ, সেখানে বেড়াতে যেতে পারিস।”
“ঠিক আছে মামা।”
“আমি দুদিনের মাঝে চলে আসব। চান মিয়ার বাড়ির উপর দিয়ে যাব, সে যদি এর মাঝে রওনা দিয়ে না থাকে তা হলে তাকে পাঠিয়ে দেব। কোনো চিন্তা করিস না।”
মামা খুব তাড়াতাড়ি একটা ব্যাগে দরকারি কিছু জিনিস ভরে নিয়ে বের হয়ে গেলেন। যাবার আগে রাজুর হাতে বাসার চাবি আর বেশকিছু টাকা দিয়ে গেলেন, যদি হঠাৎ করে কোনো কারণে দরকার হয় সেজন্যে। মামার সাথে আসার সময় আব্বাও বেশকিছু টাকা দিয়েছেন। সব মিলিয়ে রাজুর কাছে অনেক টাকা, ইচ্ছে করলে মনে হয় একটা ছাগল নাহয় গোরুর বাচ্চা কিনে ফেলতে পারবে।
.
মামা চলে যাবার পর হঠাৎ মনে হয় সারা বাসাটা বুঝি ফাঁকা হয়ে গেছে। বাসাটা হঠাৎ এত ছমছমে নির্জন হয়ে যায় যে দিনদুপুরে সাগর আর রাজুর কেমন জানি ভয়-ভয় লাগতে থাকে। রাজু অবিশ্যি খুব চেষ্টা করল তার ভয়-ভয় ভাবটা ঢেকে রাখতে। এমনভাবে কথা বলতে লাগল যেন নির্জন একটা বাসায় একা একা থাকাটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। দুজনে ঘরের ভিতরে বসে বই পড়ার চেষ্টা করতে থাকে, আর যখনই খুট করে একটা শব্দ হয় তখন দুজনেই একসাথে চমকে ওঠে, তারপর ছুটে গিয়ে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে দেখে চান মিয়া এসেছে কি না।
ঘণ্টাখানেক এভাবে কাটিয়ে দেওয়ার পর রাজু বলল, “চল, বাইরে থেকে ঘুরে আসি।”
সাগর চোখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় যাবে?”
“এই তো এদিক-সেদিক।”
”কেন?”
“বসে বসে অপেক্ষা করে করে বিরক্তি লেগে গেছে। বাইরে থেকে ঘুরে এলে সময়টা কাটবে আর খিদেটাও লাগবে ভালো করে। আমরা যখন আসব তখন দেখব চান মিয়া সবকিছু রান্না করে রেখেছে।”
“যদি না করে?”
রাজু রেগে উঠে বলল, “কেন করবে না? মামা তার বাড়ি হয়ে যাচ্ছেন না?”
“যদি বাড়িতে না পান?”
“তা হলে মামা অন্য ব্যবস্থা করবেন।”
সাগর তবু নিশ্চিন্ত হয় না, সবকিছুতে সন্দেহ করা হচ্ছে তার স্বভাব। সাগর অবিশ্যি শেষ পর্যন্ত বাইরে যেতে রাজি হল, না হয়ে উপায়ও ছিল না, সাগর না গেলে রাজু একা একাই বাইরে বেড়াতে যাবে বলে তাকে জানিয়ে দিল।
বাসার পিছনে বড় বড় গাছ, তার মাঝে দিয়ে ছোট একটা হাঁটাপথ চলে গেছে। পথের দুধারে ঝোঁপঝাড়, তার মাঝে নানারকম বুনো ফুল ফুটে আছে। হেঁটে হেঁটে তারা একটা বিশাল পুকুরের তীরে হাজির হয়, পুকুরটা ঘিরে নানারকম গাছ, দেখা চোখ জুড়িয়ে যায়। পুকুরের একদিকে একটা শান-বাঁধানো ঘাট, সেখানে চমৎকার বসার জায়গা। রাজু বলল, “আয় গিয়ে বসি।”
সাগর বলল, “মামা পুকুরে যেতে নিষেধ করেছেন মনে নেই?”
“আমরা পুকুরে যাচ্ছি না, বসার জায়গাতেই বসছি।”
সাগর গজগজ করতে লাগল, রাজু সেটাকে গুরুত্ব না দিয়ে শান-বাঁধানো ঘাটে পা ছড়িয়ে বসে। চারিদিকে কেমন জানি সুমসাম নীরবতা। গাছগুলিকে মন হচ্ছে মানুষ, সবাই যেন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। রাজু অনেকটা নিজের মনে বলল, “ইশ, কী সুন্দর!”
সাগর এতক্ষণ গজগজ করছিল, এখন হঠাৎ ফোঁশ করে উঠে বলল, “এর মাঝে সুন্দর কী আছে?”