“পারি মামা।”
“ঠিক আছে, তা হলে দেখা যাক তুই সত্যি সত্যি মোটর-সাইকেল চালাতে পারিস কি না। ব্যাপারটা যত সোজা মনে হল আসলে তত সোজা না। ব্যালেন্স রাখার ব্যাপারটা সোজা হতে পারে, কিন্তু ক্লাচ চেপে ধরে গিয়ার পালটানো ব্যাপারটা এত সোজা না। প্রথম প্রথম ফাস্ট গিয়ারেই প্র্যাকটিস করা যাক, দেখি কতদূর কী হয়।”
সাগর একটু দূর থেকে হিংসা-হিংসা চোখে তাকিয়ে রইল, আর তার মাঝে রাজু আজগর মামার কথামতো চাবি দিয়ে অন করে স্টাটারে লাথি মেরে মোটর সাইকেলের ব্রেকটা ছেড়ে দিলে সে খুব ধীরে ধীরে এগুতে শুরু করল। মামা সাথে সাথে একটু এগিয়ে গেলেন, দেখা গেল রাজু একা একাই বেশ চালিয়ে নিয়ে গেল। খানিক দূর গিয়ে সে ব্রেক চেপে মোটর-সাইকেলটা থামিয়ে দিয়ে মামার দিকে ঘুরে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসল।
মামা বললেন, “এই তো হয়েছে, এখন ঘুরে আয় দেখি!” রাজু নিজে নিজেই ঘুরে এল।
মামা পিঠে হাত দিয়ে বললেন, “এই তো মোটামুটি শিখে গেছিস, আজকে এই পর্যন্তই থাক–কাল আবার চালাবি।“
রাজু বলল, “মামা, আরেকটু চালাই? বেশি দূরে যাব না, এই উঠোনেই ঘুরে আসব, তুমি বসে বসে দেখো।”
অন্য কেউ হলে রাজুকে একটা বাঘা ধমক দিত, কিন্তু মামা বেশ সহজে রাজি, হয়ে গেলেন। বারান্দায় একটা চেয়ার এনে খবরের কাগজ নিয়ে বসলেন। সাগর হিংসা-হিংসা চোখে তাকিয়ে রইল, আর তার মাঝে রাজু বিশাল মোটর সাইকেলটা চালিয়ে বেড়াতে লাগল।
কিছুক্ষণের মাঝেই আজগর মামা আবিষ্কার করলেন, মোটরসাইকেল চালানোর ব্যাপারে রাজুর বেশ নিজস্ব একটা দক্ষতা আছে। ব্যাপারটা সে এত চমৎকারভাবে আয়ত্ত করে ফেলল যে মামা নিজে থেকেই তাকে কেমন করে গিয়ার পালটাতে হয় শিখিয়ে দিলেন। মামার ধারণা ছিল ব্যাপারটা করতে গিয়ে রাজু গোলমাল করে আজকের দিনের মতো ক্ষান্ত দেবে। কিন্তু দেখা গেল রাজু কোনো গোলমাল করল না এবং মোটামুটি বেশ ভালো গতিতে রাস্তা দিয়ে ছুটে গেল।
রাজু প্রায় নেশাগ্রস্তের মতো মোটরসাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিল এবং কতক্ষণ এভাবে চলত বলা মুশকিল, কিন্তু ঠিক তখন মামার সাথে কিছু মানুষ দেখা করতে এল। অনেক দূর থেকে এসেছে, মামা তাদের ভিতরে গিয়ে হাতমুখ ধোয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন, তাদের সাথে সাথে বলতে হবে, মামার রাজুর দিকে নজর দেবার সময় নেই। রাজু বাধ্য হয়ে মোটর-সাইকেলটা বন্ধ করে তুলে রাখল।
মানুষগুলি গ্রামের মানুষ, অনেকেই লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরে এসেছে। একজন ফুলপ্যান্ট শার্ট পরে এসেছে, তার চোখে চশমা এবং মুখে গোঁফ আছে, তবুও তাকে দেখে কেমন জানি গ্রামের মানুষ বলে বোঝা যায়। মামা জিজ্ঞেস করলেন, “কী খবর ইদরিস মিয়া?”
ইদরিস মিয়া শুকনো মুখে বলল, “খবর বেশি ভালো না।”
“কেন, কী হয়েছে?”
“খবিবুর রহমান”
নামটা শুনেই মামা কেমন জানি শক্ত হয়ে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, “কী করেছে খবিবুর রহমান?”
“ফতোয়া দিয়েছে মেয়েদের স্কুলে যাওয়া হারাম।”
“তাই ফতোয়া দিয়েছে?”
“জি। গ্রামের দুইটা মেয়ের পিঠে দোররা মেরেছে। এখন তার মুরিদেরা লাঠিসোটা নিয়ে তৈরি হচ্ছে মেয়েদের স্কুলটা ভেঙে ফেলার জন্যে।”
“স্কুল ভেঙে ফেলবে?”
“জি।”
আজগর মামার মুখ রাগে থমথম করতে লাগল। রাজু এর আগে মামাকে কখনও রাগ হতে দেখেনি। সত্যি কথা বলতে কী মামা যে রাগ হতে পারেন সেটাই তার জানা ছিল না। দেখল, মামা ভয়ংকর রাগ হতে পারেন, আর মামা যখন রেগে যান তখন তাঁকে দেখে ভয়ে হাত-পা শীরের মাঝে সেঁধিয়ে যেত চায়।
মামা কিছু না বলে পাথরের মতো মুখ করে বসে রইলেন। ইদরিস মিয়া খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, “আপনার একবার যাওয়ার বিশেষ প্রয়োজন।”
মামা কিছু বললেন না। কিন্তু তার মুখে এবারে চিন্তার একটা ছায়া পড়ল। ইদরিস মিয়া বলল, “আরও ব্যাপার আছে।”
“কী ব্যাপার?”
ইদরিস মিয়া ইতস্তত করে বলল, “এখানে বাচ্চাকাচ্চা আছে, তাদের সামনে বলতে চাই না। যদি যান তা হলে তো শুনবেনই–”
রাজু বুঝতে পারল ইদরিস মিয়া তাদের সামনে বলতে চাইছে না, এখন কি তাদের সামনে থেকে সরে যাওয়া দরকার? সরে যেতে হলে মামা নিশ্চয়ই বলবেন। মামা কিছু বললেন না, তাই রাজুও সরে গেল না।
আজগর মামা উঠে দাঁড়িয়ে হেঁটে এসে ঘরের চৌকাঠ ধরে দূরে তাকিয়ে থেকে বললেন, সমস্যা হয়ে গেল ইদরিস মিয়া।”
“কী সমস্যা?”
“এই যে আমার দুইজন ভাগনেকে নিয়ে এসেছি, এদের ফেলে যাই কেমন করে?”
“দুই একদিনের ব্যাপার–”
“একা একা থাকবে এরা?”
“একা কেন? চান মিয়া তো আছে।”
“তা আছে–এখনও এসে পৌঁছায়নি অবিশ্যি।”
ইদরিস মিয়া মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, “সে তো এসে পৌঁছে যাবে। আপনি যদি বলেন আমাদের একজন থাকতে পারে এখানে।”
উপস্থিত মানুষেরা জোরে জোরে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। একজন মানুষ বলল, “গ্রামের অবস্থা ভালো না, না হলে তো আমরা সাথেই নিয়ে যেতাম।”
ইদরিস মিয়া বলল, “আপনার ভাগনে তো আমাদেরও ভাগনে।”
আজগর মামা বললেন, “তা ঠিক, কিন্তু এই অবস্থায় এদের গ্রামে নেওয়া ঠিক না।”
সবাই চুপ করে বসে রইল, আর মামা তখন অন্যমনস্কভাবে ঘুরে রাজুর দিকে তাকালেন, তাঁর মুখে একই সাথে একটু দুঃখ আর একটু লজ্জার ভাব। মামা
কী বলতে চাইছেন হঠাৎ করে রাজু বুঝে গেল, তাই মামা বলার আগেই সে বলে ফেলল, “মামা, আমরা দুই-একদিন একা একা থাকতে পারব, আমাদের কোনো অসুবিধা হবে না।”