“সত্যি-মিথ্যা জানি না, তোক বলে। চল চল, দেরি করিস না।”
মামা তাঁর মোটর-সাইকেলে বসলেন, মামার পিছনে বসল সাগর, সাগরের পিছনে রাজু। মামা বললেন, “ধরেছিস তো শক্ত করে?”
রাজু আর সাগর বলল, ধরেছি মামা।”
মামা স্টার্টারে লাথি দিতেই মোটর-সাইকেল গর্জন করে উঠল, তারপর মামা পা তুলে মোটর-সাইকেল ছুটিয়ে নিয়ে চললেন। রাজু আগে কখনও মোটর সাইকেলে ওঠেনি, তার কী যে মজা লাগল সে আর বলার মতো নয়! মনে হতে লাগল বুঝি সে উড়ে যাচ্ছে।
বাতাসের ঝাঁপটা লাগছে মুখে, রাস্তা পিছনে ছুটে যাচ্ছে রাস্তার পাশে গাছপালা হুশ হুশ করে বের হয়ে যাচ্ছে। সে চিৎকার করে বলল, “আরও জোরে মামা–আরও জোরে।”
মামা সত্যি সত্যি আরও জোরে ছোটালেন। এতক্ষণে সাগরও মজা পেয়ে গেছে, সে চিৎকার করে বলল, “আরও জোরে।“
মামা আরও জোরে ছুটলেন, মোটর-সাইকেল জীবন্ত প্রাণীর মতো গর্জন করতে লাগল। রাজু বলল, “আরও জোরে মামা।”
আজগর মামা মাথা পিছনে ঘুরিয়ে বললেন, “আরও জোরে গেলে তো উড়ে যেতে হবে!”
“উড়েই যাও মামা–উড়ে যাও।”
মামা শরীর নাড়িয়ে নাড়িয়ে উড়ে যাবার ভান করতে লাগলেন। তাই দেখে সাগর আর রাজু হি হি করে হাসতে লাগল।
প্রায় ঘণ্টাখানেক গিয়ে মামা একটা পাহাড়ি রাস্তায় যেতে শুরু করলেন। এরকম রাস্তায় হেঁটে যেতেই জান বের হয়ে যাবার কথা, মোটর-সাইকেলে যাবার তো কোনো প্রশ্নই আসে না, কিন্তু মামাকে সেটা নিয়ে খুব চিন্তিত দেখা গেল না, চোখ বন্ধ করে মোটর সাইকেল ছুটিয়ে নিতে লাগলেন। ঝাঁকুনি খেতে খেতে যখন রাজুর মনে হতে লাগল তার মগজ এখন নাক-মুখ দিয়ে বের হয়ে আসবে তখন মামা থামলেন। সামনে একটা উঁচু পাহাড়, আর সেই উঁচু পাহাড় থেকে ঝরঝর করে পানি পড়ছে। নিচে বড় বড় একটা পাথর, সেখানে পড়ে পানি চারিদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যাচ্ছে। জায়গাটি নির্জন সুমসাম–বহু দূরে একটা পাহাড়ের উপর রঙিন কাপড় পরে কয়টা পাহাড়ি মেয়ে বসে আছে, এ ছাড়া আশেপাশে কোথাও কেউ নেই।
মামা মোটরসাইকেল থেকে নেমে বললেন, “কী বলেছিলাম, সুন্দর না?”
রাজু আর সাগর মাথা নাড়ল।
“এখন তো ঝরনাটা শুকিয়ে গেছে। বর্ষাকালে এলে দেখবি কী ভয়ংকর ঝরনা–দুই মাইল দূর থেকে এর গর্জন শোনা যায়!”
“সত্যি?”
”সত্যি। মামা মাথা নাড়লেন, বর্ষাকালে শুধু একটা সমস্যা।”
“কী সমস্যা মামা?”
“জোক। খুব জোঁকের উপদ্রব হয় তখন।”
“জোক? ইয়াক থুঃ–” সাগর মুখ কুঁচকে মাটিতে থুতু ফেলল।
রাজু পানির দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, “পানিতে নামি, মামা?”
“ইচ্ছে হলে নাম।”
রাজু জুতো খুলে পানিতে নামল, পরিষ্কার টলটলে পানি, আর কী ঠাণ্ডা, রাজুর সারা শরীর কেমন জানি শিরশির করে ওঠে! সাগর কিছুক্ষণ জোঁকের ভয়ে তীরে দাঁড়িয়ে থেকে শেষ পর্যন্ত আর লোভ সামলাতে পারল না, সেও জুতো খুলে নেমে এল। ঝকঝকে পরিষ্কার পানিতে ছোট ছোট মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে। সাগর আর রাজু খানিকক্ষণ সেই মাছ ধরার চেষ্টা করল, এইটুকুন ছোট ছোট মাছ, কিন্তু কী বুদ্ধি সেই মাছের, কিছুই ধরা দিল না।
মামা একটা পাথরে লম্বা হয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁকে দেখে মনে হতে লাগল আকাশে বুঝি কেউ একটি বই খুলে রেখেছে আর মামা একমনে সেই বইটা পড়ছেন।
রাজু আর সাগরকে নিয়ে মামা ঘণ্টাখানেক ঝরনার কাছে থাকলেন, তারপর ঘড়ি দেখে বললেন, “চল বাসায় যাই। খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে জিন্দা আগুন দেখতে যাব।”
পানিতে লাফঝাঁপ দিতে ভারি মজা, এখান থেকে যেতে ইচ্ছে করছিল না, কিন্তু জিন্দা আগুনের কথা শুনে দুজনেই লাফিয়ে উঠে জুতো-মোজা পরে নিতে থাকে।
ফিরে আসার সময় মামা বাজারের কাছে একটা রেস্টুরেন্টে থামলেন। দুপুর হয়ে গেছে, বাসায় ফেরার আগে খেয়ে নিতে চান। রাজু একবার বিখ্যাত বাবুর্চি চান মিয়া এবং তার বেহেশতি পরোটার কথা মনে করিয়ে দিল, আজগর মামা আর ঝুঁকি নিলেন না। বাসায় গিয়ে যদি দেখা যায় চান মিয়া এখনও এসে পৌঁছায়নি, আবার তা হলে পাউরুটি আর ডিম ভাজার পরে বিচিকলা খেতে হবে।
খেয়েদেয়ে বাসায় ফিরে আসতে আসতে দুপুর গড়িয়ে গেল। আজগর মামা এই এলাকায় খুব জনপ্রিয় মানুষ বলে মনে হল, যার সাথেই দেখা হয় সেই মামার সাথে খানিকক্ষণ কথা বলে নেয়।
বাসায় পৌঁছে মামা যখন তাঁর মোটর-সাইকেলটা তুলে রাখছেন তখন রাজু বলল, “মামা, আমি তোমার মোটর-সাইকেলটা একটু চালাই?”
মামা চোখ কপালে তুলে বললেন, “কী বললি?”
“তোমার মোটর-সাইকেলটা চালাই?”
“তুই মোটরসাইকেল চালাতে পারিস?”
রাজু মাথা নাড়ল, “না, পারি না।”
“তা হলে?”
“তুমি শিখিয়ে দেবে।”
অন্য কোনো মানুষ হলে এই সময়ে রাজুকে একটা বাঘা ধমক দেওয়া হত, কিন্তু আজগর মামার কথা আলাদা। মামা কয়েক সেকেন্ড রাজুর দিকে তাকিয়ে দেখে বললেন, “নে, দেখি পারিস কি না!”
রাজু মোটর সাইকেলটা ধরল, দেখে বোঝা যায় না, কিন্তু বেশ ভারী, শক্ত করে ধরে রাখতে হয়। মামা বললেন হাত দিয়ে ঠেলে একটু ঘুরিয়ে আনতে। রাজু বেশ সহজেই ঘুরিয়ে আনল। তারপর মামা বললেন সীটে বসতে। রাজু সীটে বসল, মামা তখন তার দুই পা কতটুকু যায় লক্ষ করলেন। কিছু-একটা পরীক্ষা করে সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, “সাইকেল চালাতে পারিস তো?”