জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই রাজু দেখল আজগর মামা হেঁটে হেঁটে আসছেন–মানুষ যেরকম আস্তে আস্তে আপন মনে হাঁটে সেরকম হাঁটা নয়, মামা হাঁটছেন ধপ ধপ করে, দুই হাত নেড়ে নেড়ে দেখে মনে হচ্ছে বুঝি ট্রেন ধরতে যাচ্ছেন। জানালার নিচে এসে মামা উপরে তাকিয়ে রাজুকে দেখতে পেলেন, তখন হাঁটা থামিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, “উঠে গেছিস?”
রাজু মাথা নাড়ল। মামা বললেন, “আয় বাইরে আয়, দেখ কী সুন্দর সকাল।“
রাজু দরজা খুলে বাইরে এল, মামা তখন ঘাসের উপর পা ছড়িয়ে বসে হাত দিয়ে পায়ের আঙুল ধরার চেষ্টা করছেন, রাজু বলল, “তুমি এত জোরে জোরে হেঁটে হেঁটে কোথায় যাচ্ছিলে?”
“যাব আবার কোথায়? সকালে হাঁটা স্বাস্থ্যের জন্যে ভালো, জানিস না?”
“হাঁটা কোথায় মামা? তুমি তো রীতিমতো দৌড়াচ্ছিলে!”
“মেনি-বেড়ালের মতো হাঁটব নাকি? হাঁটব বাঘের মতো। বাঘের মতো হাঁটলে কার্ডিও ভাসকুলার ব্যায়াম হয়। জোরে জোরে হেঁটে হার্টবিট বাড়িয়ে দ্বিগুণ করে ফেলতে হয়, তারপর সেই হার্টবিট আধ ঘণ্টা ধরে রাখতে হয়।”
“তুমি আধা ঘণ্টা ধরে হাঁটছ?”
মামা মাথা নাড়লেন, “সকালে হাঁটতে কী ভালো লাগে! হেঁটে দেখিস। দিনের একেকটা সময় হচ্ছে একেক রকম, সকালটা হচ্ছে সবচেয়ে সুন্দর। সকালবেলা সবকিছু পবিত্র, সবকিছুতেই শান্তি। সবকিছু নরম।”
“আর দুপুর?”
“দুপুর হচ্ছে ব্যস্ততার সময়। দুপুরে কারও অবসর নেই। দুপুরে সবার জন্যে শুধু কাজ আর কাজ!”
“আর রাত?”
“রাত? রাত হচ্ছে বিশ্রামের সময়। অবিশ্যি তুই যদি চোর হোস তা হলে রাত হচ্ছে চুরি করার সময় তখন দুপুর হবে তোর বিশ্রামের সময়।
রাজু হি হি করে হেসে বলল, “তার মানে যারা দুপুরে ঘুমায় তারা সবাই চোর?”
মামাও হেসে ফেললেন, বললেন, “কে জানে, হয়তো চোর।”
রাজু বারান্দায় সিঁড়িতে বসে বসে মামার ব্যায়াম দেখতে লাগল। তার হঠাৎ করে আব্বা আর আম্মার কথা মনে পড়ল, কী করছে এখন আব্বা আর আম্মা? এখনও নিশ্চয়ই ঘুমাচ্ছেন। ঘুম থেকে উঠে কী করবেন, আবার কি ঝগড়া করবেন?
মামা ব্যায়াম শেষ করে উঠে এসে রাজুকে এক হাতে আঁকড়ে ধরে নরম গলায় বললেন, “সাগর এখনও ঘুমাচ্ছে?”
“হুঁ।“
“যা, তুলে দে ঘুম থেকে। হাতমুখ ধুয়ে নাস্তা করবি। কাল রাতেও কিছু খাসনি। কী খাবি বল। গোশত-পরোটা? আমাদের চান মিয়া একেবারে ফাস্ট ক্লাস গোশত-পরোটা তৈরি করে। বেহেশতি পরোটা। একবার খেলে তার স্বাদ মুখে লেগে যাবে, জন্মেও ভুলতে পারবি না।”
সাগরকে ঘুম থেকে তুলে হাতমুখ ধুয়ে যখন রাজু নাস্তা করতে এল তখন দেখা গেল বেহেশতি পরোটা তৈরি হয়নি। বিখ্যাত বাবুর্চি চান মিয়া–যে বেহেশতি পরোটা তৈরি করে, সে বাড়িতে গিয়েছিল এখনও আসেনি। তাকে খবর পাঠানো হয়েছে, সে নিশ্চয়ই দুপুরবেলাতেই চলে আসবে। আজগর মামা অবিশ্যি সেটা নিয়ে বেশি ঘাবড়ে গেলেন না, সকালে নাস্তা করার জন্যে বিশাল একটা বাটিতে অনেকগুলি ডিম ভেঙে সেটা খুব উৎসাহ নিয়ে ফেটাতে থাকলেন। রাজু আর সাগরকে বললেন, “সকালের নাস্তা হবে টেস্টি, অমলেট আর হরলিক্স। দুপুরবেলা খাব কাবাব-পরোটা, রাত্রে ভুনা খিচুড়ি।”
রাজুর যেরকম খিদে লেগেছে সে ইচ্ছে করলে এখন লবণ ছিটিয়ে জুতা স্যান্ডেল পর্যন্ত খেয়ে ফেলতে পারে। মামা বললেন, “আয়, হাত লাগা। পেঁয়াজ কুচি কুচি করে কাট। সাথে কাঁচামরিচ। পেঁয়াজ কাটার সময় মুখ হাঁ করে নিঃশ্বাস নিবি, তা হলে দেখিস চোখে পানি আসবে না।”
সাগর রুটি টোস্ট করল, রাজু পেঁয়াজ মরিচ কেটে দিল এবং মামা ডিম ভাজা করলেন। তারপর সবাই মিলে খেতে বসল।
রাজু প্রায় রাক্ষসের মতো খেল, আম্মা থাকলে আজ খুব খুশি হতেন। খাবার পর এক গ্লাস করে হরলিক্স খেয়ে রাজু আর সাগর মামার সাথে বারান্দায় গিয়ে বসল। মামা মোটা মোটা কিছু কলা নিয়ে বসেছেন, রাজুকে আর সাগরকে একটা করে ছিঁড়ে দিয়ে বললেন, “খাবার পর সবসময় ফল খেতে নেয়। নে খা।”
সাগর বলল, “এই কলা এত মোটা কেন মামা?”
আজগর মামা কলা ছিলে তাতে কামড় দিয়ে বললেন, “এর নাম বিচিকলা। এর মাঝে তিন লাখ তেত্রিশ হাজার বিচি। তবে খেতে ফাস্ট ক্লাস।”
মামা কলাটা খেয়ে মুখ থেকে পুট পুট করে বিচিগুলি বের করতে থাকেন, দেখে মনে হয় ভারি বুঝি মজা। সাগর আর রাজু কলা খেয়ে পুট পুট করে তার বিচি বের করার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল, মামার অনেক গুণ, তার কিছু-কিছু কোনোদিন তারা নাগালে পাবে না।
বাইরে তখন একটু বেলা হয়েছে, মামা ঘড়ি দেখে বললেন, “সকালে ঘুম থেকে ওঠার সুবিধা কী জানিস?”
“কী মামা?”
“সারাটা দিন লম্বা হয়ে যায়। কত কী করা যায় এক দিনে! চল এখন বের হই। জুতা-মোজা পর।”
রাজু উৎসাহ জুতা পরতে পরতে বলল, “কোথায় যাব মামা?”
“আমার মোটর-সাইকেল করে ঘুর আসব। এখানে একটা ঝরনা আছে, পাহাড়ি ঝরনা। অপূর্ব সুন্দর, তোদের দেখিয়ে আনি। কাল নিয়ে যাব জিন্দা আগুন দেখাতে।”
“সেটা কী মামা?”
“মাটি ফেটে গ্যাস বের হচ্ছে সেখানে দাউদাউ করে দিনরাত আগুন জ্বলছে। দেখলে মাথা ঘুরে পড়ে যাবি। আর পরশু নিয়ে যাব কিংশুনাগের মন্দিরে। দেখবি তান্ত্রিক সাধু বসে আছে। অমাবস্যা রাতে নাকি এখনও নরবলি দেয়।”
“সত্যি?”