লিকলিকে মানুষটি পেট্রোল-ভেজা রুমালে আগুন ধরিয়ে বাসের মাঝে ছুঁড়ে দেয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু তার আগেই কন্ডাক্টর, বাস-ড্রাইভার আর দুজন হেল্পার ছুটে এসে আগুনটা কেড়ে নিয়ে পা দিয়ে দাপিয়ে নিভিয়ে দিল। বাসের যাত্রীরা তখন বাস পোড়ানোর পক্ষে এবং বিপক্ষে এই দুই দলে ভাগ হয়ে একটা তুলকালাম শুরু কাণ্ড করে দিল। মামা পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, দেখে মনে হচ্ছে পুরো ব্যাপারটিতে খুব মজা পাচ্ছেন। রাজু ভয়ে পেয়ে বলল, “মামা, কিছু-একটা করো!”
সাগর তখন ঊ্যা করে কেঁদে দিল। সাগরের কান্নার জন্যেই হোক আর রাজুর কথাতেই হোক মামা তখন এগিয়ে গিয়ে তার বাজখাই গলায় একটা হাঁক দিলেন, “এই যে ভাই, সবাই আমার কথা শোনেন।”
মামার গলার আওয়াজ না শুনে কোনো উপায় নেই, সবাই মামার দিকে ঘুরে তাকাল।
মামা বললেন, “এই ব্যাটা কন্ডাক্টর ভারি ফাজিল। ব্যাটার একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার।”
“দরকার!” লোকজন চিৎকার করে বলল, যারা কন্ডাক্টরের শার্টের কলার ধরে রেখেছিল তারা এই সময়ে তাকে ধরে একটা শক্ত ঝাঁকুনি দিল।
মামা গলা উঁচিয়ে বললেন, “বাসটা পোড়ালে শাস্তি তো কন্ডাক্টরের হবে না, শাস্তি হবে বাস-মালিকের। এই ব্যাটা কন্ডাক্টর তো বাস-মালিককেও ঠকিয়ে প্যাসেঞ্জার তুলছে।”
“সত্যি কথা।” লোকজন হুঙ্কার দিল।
“তা ছাড়া আমাদের সবারই তো বাড়ি যাওয়া দরকার। এই সময়ে বাস পোড়ালে আবার বাড়ি পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাবে। পুলিশে ফুলিশে খবর দিলে আবার অন্য ঝামেলা। আমি বলি কি–”
লোকজন মামার মুখের দিকে তাকাল, “কী?”
“এই কন্ডাক্টরকে একটা শাস্তি দিয়ে আমরা বাসে করে বাড়ি যাই।”
“ঠিক কথা।” লিকলিকে মানুষটা বলল, “ঘুষি মেরে শালার সামনেই দুটো দাঁত ফেলে দিই–”
“না, না, তার দরকার নেই। একে বরং এখানে রেখে যাই। তা হলে আর রাস্তা থেকে লোক তুলতে পারবে না, আমরা তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছে যাব।”
অনেক মানুষ মামার কথায় রাজি হল, উত্তেজনার প্রথম ধাক্কাটা কমে এসেছে, এখন সবাই চাইছে একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান। লিকলিকে মানুষটা শুধু তখনও চিৎকার করে যাচ্ছে, “না, এত সহজে ছাড়লে হবে না। ধরে আগে শক্ত মার দিই–”
কয়েকজন মানুষ তখন লিকলিকে মানুষটাকে শান্ত করার চেষ্টা করে, কিন্তু সে সহজে শান্ত হবার পাত্র নয়–মানুষ রোগা হলে মনে হয় তাদের রাগ খুব বেশি হয়।
শেষ পর্যন্ত লিকলিকে মানুষটাও রাজি হল, কিন্তু এক শর্তে। কন্ডাক্টরকে একটা সুপারি গাছে বেঁধে যাবে। সে কারও কথা শুনল না, একটা গামছা দিয়ে কন্ডাক্টরকে রাস্তার পাশে একটা সুপারি গাছে বেঁধে ফেলল।
বাস-ড্রাইভার এবং হেল্পার দুজন একটা কথাও বলল না, তাদের মুখ ফ্যাকাশে এবং রক্তশূন্য, বাসটি যে সত্যি সত্যি পুড়ে যায়নি এতেই তারা খুশি। মামা তখন সবাইকে বাসে উঠে বাস ছেড়ে দিতে বললেন, বাসকে ঘিরে তখন আশেপাশের অনেক মানুষ জমা হয়ে গেছে। বাসটা যখন ছেড়ে দিচ্ছিল মামা জানালা দিয়ে গলা বের করে তাদের বললেন, “ভাই, লোকটাকে খুলে দেবেন একটু পরে। মনে হয় অনেক শাস্তি হয়েছে।”
এরপর বাস আর কোথাও থামল না, টানা চার ঘণ্টা চলে যখন শহর পৌঁছাল তখন রাত দশটা। আম্মা বিস্কুটের প্যাকেট আর পানি দিয়েছিলেন বলে রক্ষা, সেটা দিয়েই রাতের খাবার সারতে হল। বাসে বসে বসে রাজু আর সাগর মামার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গিয়েছিল। বাস থেকে নামার সময় তাদেরকে ডেকে তুলে নামালেন, আধো ঘুমে তারা মামার সাথে গিয়ে স্কুটারে উঠে বসল। মামা বললেন, “ঘুমাবি না কিন্তু, বাসায় গিয়ে খেতে হবে। জেগে থাক।”
রাজু আর সাগর জেগে থাকতে চেষ্টা করল, টের পাচ্ছিল পাহাড়ি উঁচুনিচু রাস্তায় স্কুটার ছুটে যাচ্ছে, কিন্তু সারাদিনের ক্লান্তি হঠাৎ যেন চোখে এসে ভর করেছে। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল, হঠাৎ প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে আবার ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল–এর মাঝে কীভাবে জানি দুজনেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।
৩. তৃতীয় দিন
রাজুর ঘুম ভাঙল খুব ভোরে। নতুন জায়গায় রাজু বেশি ঘুমাতে পারে না। তা ছাড়া আজগর মামার বাসাটা একটা জঙ্গলের মাঝে, চারপাশে গাছগাছালি, সারারাত নানারকম জন্তু-জানোয়ার, নাম-না-জানা বিচিত্র সব পাখি ডাকাডাকি করে। এরকম জায়গায় বেশিক্ষণ ঘুমিয়ে থাকা খুব সোজা ব্যাপার না। রাজু চোখ কচলে বাসি ঘুম দূর করে বিছানা থেকে নামল। সাগর এখনও ঘুমিয়ে কাদা হয়ে আছে। বিশাল বড় একটা ঘরে, আরও বড় একটা বিছানায় আজগর মামা কাল রাতে তাদের শুইয়ে দিয়েছিলেন, তাদের কিছু মনে নেই। রাজুকে নিশ্চয়ই মামা কোলে করে আনেননি, সে নিশ্চয়ই হেঁটে হেঁটে এসেছে, কিন্তু রাজু এখন আর কিছু মনে করতে পারে না।
রাজু বিছানা থেকে নেমে হেঁটে হেঁটে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল, বাইরে কতরকম গাছপালা, তার মাঝে থেকে কত বিচিত্র রকম শব্দ আসছে! পাখির ডাক, পোকার ডাক, বাতাসের শব্দ, গাছপালার পাতার শব্দ, ডালের সাথে ডালের ঘষা খাওয়ার শব্দ, পাখির পাখা ঝাঁপটানোর শব্দ, শুকনো পাতা উড়ে শব্দ, তার মাঝে সরসর করে কিছু-একটা ছুটে যাবার শব্দ। কী আশ্চর্য-না লাগছে শুনতে! তার উপর হালকা কুয়াশায় চারিদিকে ঢেকে আছে, দেখে মনে হয় যেন এটা সত্যি নয়, যেন কেউ স্বপ্ন থেকে তুলে এনে দিয়েছে।