“তোমার বাস তো দেখি মুড়ির টিন! সব জায়গায় থামতে থামতে যাবে, নাকি একবারে যাবে?”
“ডিরেক্ট বাস, ডিরেক্ট! আর কোথাও থামাথামি নাই–”
কন্ডাক্টর মামার সাথে কথা বলতে বলতে চোখের কোনা দিয়ে কী যেন দেখছিল, হঠাৎ দূরে কী-একটা দেখে সে খুব চঞ্চল হয়ে ওঠে, মামা, রাজু আর সাগরকে প্রায় ঠেলে তুলে বাসের গায়ে দমাদম মারতে শুরু করল। সাথে সাথে বাস ছেড়ে দিল।
ভিতরে খুব ভিড়, লোকজন গাদাগাদি করে আছে। তার মাঝে কন্ডাক্টর পিছলে পিছলে ঢুকে গিয়ে একটা সীট থেকে নিরীহ দুইজন লোককে ধমকাধমকি করে তুলে দিয়ে আজগর মামাকে ডাকতে থাকে। মামা অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, “সে কী! ওদের তুলে দিচ্ছ কেন?”
কন্ডাক্টর অবিচল মুখে বলল, “কোনো অসুবিধা নাই। সীটের জন্য আলাদা ভাড়া। না দিলে খাড়াইয়া যাবে।”
মামা রাজু আর সাগরকে নিয়ে চাপাচাপি করে বসলেন। বাসের সীটগুলি এত কাছাকাছি যে ব্যাগগুলি পর্যন্ত রাখার জায়গা নেই। অনেক কষ্ট করে সীটের ফাঁকে সেগুলি ঢোকানো হল।
বাস ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ছুটে চলছে, তার ভিতরে কন্ডাক্টর দুই হাত ছেড়ে অন্য যাত্রীদের গায়ে হেলান দিয়ে ভাড়া নিতে থাকে। রাজু কিছুক্ষণের মাঝে আবিষ্কার করল কন্ডাক্টর মানুষটির কথাবার্তা খুব খারাপ। বিশেষ করে যেসব মানুষ একটু গরিব ধরনের তাদের সাথে এমনভাবে কথা বলে যে শুনে গা জ্বলে যায়। লোকজনকে ধমক দিয়ে গালিগালাজ করে বাসের মাঝে সে মোটামুটি একটা ভয়ংকর অবস্থা তৈরি করে ফেলল।
বাসে ওঠার সময় কন্ডাক্টর বলেছিল বাসটা আর কোথাও থামবে না, কিন্তু দেখা গেল আসলে কথাটি সত্যি নয়। পাঁচ-দশ মিনিট পরে পরে বাসটি থামতে লাগল। শুধু তা-ই না, এমনিতেই বাসে কারও বসার জায়গা নেই, তার মাঝে কন্ডাক্টর ঠেলে ঠেলে আরও মানুষ এনে ঢোকাতে লাগল। কিছুক্ষণের মাঝে মনে হল, বাস নয়, এটি বুঝি পল্টনের জনসভা। এই ভিড়ের মাঝে একজন একটা পাহাড়ি হালুয়া বিক্রি করতে লাগল, এটি নাকি স্বপ্নপ্রদত্ত ঔষুধ এবং এটি খেলে এমন কোনো অসুখ নেই যেটি ভালো হয় না। লোকজন মনে হয় আজকাল একটু বুদ্ধিমান হয়েছে, কারণ ঔষধের দাম কমাতে কমাতে প্রায় বিনি পয়সার দিয়ে দিচ্ছিল, তবু কেউ একটি শিশি পাহাড়ি হালুয়া কিনল না।
বাসের যাত্রাটা কিছুক্ষণের মাঝে আরও ভয়ংকর হয়ে উঠল, কারণ এই বাসটি যেসব যাত্রীকে থেমে থেমে তুলে নিচ্ছে তারা নিশ্চয়ই পিছনের বাসের যাত্রী। পিছনের বাসটি যাত্রীদের জন্যে এই বাসটি ধরে ফেলল আর তখনই দুই বাসে রেস শুরু হয়ে গেল। এত বড় বাস যে এত জোরে ছুটতে পারে না দেখলে বিশ্বাস হয় না, দেখে মনে হল এবারে একটা অ্যাকসিডেন্ট না হয়ে যায় না।
ঠিক এরকম সময় বাসের কান্ডাক্টর গরিব ধরনের একজন যাত্রীকে অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিয়ে বসে। মনে হয় ঠিক এই জিনিসটারই দরকার ছিল, হঠাৎ করে তিড়িং করে সামনে বসে থাকা একজন লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায়, মানুষটা লিকলিকে শুকনো এবং কালো, চোখে চশমা এবং মুখে গোঁফ, দেখে মনে হয় কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। মানুষটি চিৎকার করে বলল, “বাস থামা!”
কন্ডাকটর চোখ পাকিয়ে বলল, “বাস কি আপনার বাবার?”
আর যার কোথায়, লিকলিকে মানুষটি এই ভিড়ের মাঝে গেল কীভাবে কীভাবে এসে কন্ডাক্টরের শার্টের কলার চেপে বলল, “কী বললি হারমজাদা?”
কন্ডাক্টর এবার একটু ঘাবড়ে গেল, তবু ঘাড় বাঁকা করে বলল, “লাইনের বাস কি আপনার কথায় থামানো যায়?”
“থামা বলছি এক্ষুনি।”
“কেন?”
“তোমার বাস জ্বালিয়ে দেব।”
সাথে সাথে সমস্ত বাসে একটা আনন্দধ্বনি উঠল এবং বেশির ভাগ প্যাসেঞ্জার উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “জ্বালিয়ে দাও। শালার বাস জ্বালিয়ে দাও।”
কয়েকজন ছুটে গেল ড্রাইভারের কাছে, চুলের মুঠি ধরে বলল, “থামা শালা বাস।” কিছু মানুষ এসে কন্ডাক্টরকে বাসের দেয়ালে ঠেলে ধরল। মনে হল দু চারটে কিলঘুষিও পড়ল, অন্যেরা বাসের ছাদে মেঝেতে লাথি মারতে লাগল। অবস্থা বেগতিক দেখে বাসের ড্রাইভার তাড়াতাড়ি রাস্তার পাশে বাস এনে থামায়, সাথে সাথে পাশ দিয়ে পিছনের বাসটি হুশ করে বের হয়ে গেল।
বাস থামা মাত্রই লিকলিকে মানুষটি বাস থেকে নেমে চিৎকার করে বলল, “সবাই নামেন ভাই বাস থেকে, এই বাস জ্বালিয়ে দেব।”
কিছু-কিছু প্যাসেঞ্জারের মনে একটু সন্দেহ ছিল, কিন্তু দেখা গেল লিকলিকে মানুষটি সত্যিই বাস পুড়িয়ে দেবে বলে ঠিক করেছে। তার আরও কিছু অ্যাসিস্টেন্ট জুটে গেছে, তারা সবাই মিলে সত্যি সত্যি বাস পোড়ানোর ব্যবস্থা করতে থাকে। একজন গিয়ে পেট্রোল ট্যাংকটা খুলে সেখানে একটা রুমাল ভিজিয়ে আনে, একটা দেয়াশলাইও বের হয়ে আসে।
রাজু ভয়ে পেয়ে বলল, “মামা, সত্যি সত্যি বাস পুড়িয়ে দেবে?”
মামা দাঁত বের করে হাসলেন, বললেন, “মনে হয়। এই লাইনে এখনও একটা দুইটা বাস পোড়ানো হয়নি, তাই কন্ডাক্টরগুলির বড় বাড় বেড়েছে।”
“কিন্তু মামা, সত্যি সত্যি বাস পুড়িয়ে দেবে? তুমি কিছু বলবে না?”
মামা চোখ মটকে বললেন, “দেখি না কী হয়। এই কন্ডাক্টর মানুষটা বড় ফাজিল, ব্যাটার খানিকটা শাস্তি হওয়া দরকার। তা ছাড়া—”
“তা ছাড়া কী মামা?”
“আমি কখনও বাস পোড়ানোনা দেখিনি। দেখি কেমন করে পোড়ায়।”