- বইয়ের নামঃ রাজু ও আগুনালির ভূত
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ অনুপম প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. প্রথম দিন
দুপুরবেলার দিকে রাজুর মন একটা গভীর ভাবের জন্ম হল। রাজুর বয়স তেরো এবং এই বয়সেই তার মনে নানারকম গভীর ভাবের জন্ম হয়। তখন সে দুই হাত মাথার পিছনে দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে সেই গভীর ভাব নিয়ে চিন্তাভাবনা করে। এরকম সময়ে তার মুখের দিকে তাকালে মনে হয় তার পেট ব্যথা করছে, কারণ কোনো-একটা কারণে তার দুই চোখ কুঁচকে যায় এবং মুখে কেমন জানি একটা যন্ত্রণার ভাব চলে আসে।
রাজুর মনে যখন গভীর ভাবের জন্ম হয় তখন যারা রাজুকে ভালো করে চেনে তারা তাকে ঘাটায় না। ঘাঁটিয়ে অবিশ্যি লাভও হয় না। কারণ, সে তখন কোনো প্রশ্নের উত্তর দেয় না। তবে সাগরের কথা আলাদা, সে রাজুর ছোট ভাই, তার বয়স মাত্র সাত, কিন্তু কোনো কোনো বিষয়ে তার ধৈর্য প্রায় একশো বছরের মুণিঋষিদের মতো। রাজু কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিলেও সে ধৈর্য ধরে প্রশ্ন করে যেতে থাকে এবং প্রায় সবসময়েই সাগর রাজুকে তার গভীর ভাবের জগৎ থেকে টেনে নিচে নামিয়ে আনতে পারে। রাজু তার জীবনের যে-তিনটি জিনিসকে সত্যি সত্যি অপছন্দ করে তার একটি হচ্ছে সাগর, অন্য দুটি হচ্ছে ঢ্যাঁড়শ ভর্তা এবং মাকড়শা। ঢ্যাঁড়শ ভর্তা এখনও কেউ তাকে খাওয়াতে পারেনি, মাকড়শা দেখামাত্র সে ঝাঁটা দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলে, কিন্তু সাগরকে নিয়ে সে এখনও কিছু করতে পারেনি। রাজু মোটামুটি নিশ্চিত তার বয়স আঠারো বছর হওয়ার আগেই সে কোনো একদিন সাগরকে আছাড় দিয়ে মেরে ফেলবে। রাগের মাথায় খুন করলে নাকি ফাঁসি হয় না, কাজেই তারও মনে হয় ফাঁসি হবে না, বড়জোর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়ে যাবে। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলে নাকি চৌদ্দ বছর পর জেল থেকে বের হয়ে আসা যায়, তখন তার বয়স হবে সাতাশ, কাজেই তার পরেও মোটামুটি কিছু-একটা করে বেঁচে থাকা যাবে।
আজ দুপুরবেলাতেও সাগর না জেনেশুনে তার জীবনের উপর একটা বড় ঝুঁকি নিয়ে ফেলল। রাজু তখন তুই হাত মাথার নিচে দিয়ে আকাশের একটা চিলের দিকে তাকিয়েছিল। চিলটির দিকে তাকিয়ে থাকলেও সে এখন চিলটাকে আর দেখছে না, কারণ, তার মাথায় এখন খুব একটা জটিল চিন্তা খেলা করছে। ঠিক এই সময় সাগর রাজুর কাছে এসে বলল, “ভাইয়া, এই দেখো কী হয়েছে।”
রাজু তার কথা শুনল না। শুনলেও তার মুখ দেখে সেটা বোঝা গেল না। সাগর তখন রাজুর কাঁধ-ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “এই দেখো ভাইয়া।”
রাজু তখনও আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল, শুধু তার মুখের যন্ত্রণার ভাবটা আরেকটু গাঢ় হয়ে উঠল। সাগর অবিশ্যি তাতে নিরুৎসাহিত হল না, তার ডান হাতটা রাজুর নাকের সামনে ধরে বলল, “চকলেটটা মুঠো করে ধরে রেখেছিলাম, দেখো কী হয়েছে!”
রাজুকে দেখতে হল। চকলেট মুঠো করে রাখলে চকলেট গলে যায়–অনেকক্ষণ মুঠো করে রাখলে সেই গলে-যাওয়া চকলেট আঙুলের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে বের করে একটা জঘন্য ব্যাপার হয়–কনুই পর্যন্ত সারা হাত আঠালো চটচটে হয়ে যায় এবং মাছিরা কোনো কারণে সেটা খেতে খুব পছন্দ করে। সাগরকে ঘিরে কিছু মাছি ভ্যান ভ্যান করছিল এবং সেটা নিয়ে সাগরের কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হল না। সে তার চটচটে হাত জিব বের করে একবার চেটে বলল, “চেটে খেলে মনে হয় আইসক্রিম। তুমি খাবে?”
রাজু অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করে বলল, “না, খাব না। ভাগ এখান। থেকে।”
সাগর তবু নিরুৎসাহিত হল না, হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “একবার চেটে দেখো কেমন মিষ্টি মিষ্টি আবার নোনতা নোনতা লাগে।”
“নোনতা লাগে তোর হাতের ময়লার জন্যে। গাধা।”
সাগর মুখ শক্ত করে বলল, “তুমি গাধা।”
“দেব একটা থাপ্পড়। ভাগ এখান থেকে।”
বয়সে বড়দের মান-সম্মান রেখে কথা বলাটা সাগর এখনও শেখেনি, মনে হয় তার শেখার কোনো ইচ্ছাও নেই। চকলেট-মাখা হাতটা উপরে তুলে বলল, “আমি দেব একটা থাপ্পড়।”
রাজু চোখ লাল করে বলল, “দিয়ে দেখ আমি তোর অবস্থা কী করি।”
রাজু কী করে সেটা দেখার জন্যেই মনে হয় সাগর একটা থাবড়া বসিয়ে দিচ্ছিল। শেষ মুহূর্তে থেমে গিয়ে চকলেট-মাখা হাতটা মুখে পুরে একবার চেটে নিয়ে বলল, “তুমি পৃথিবীর মাঝে সবচেয়ে খারাপ ছেলে।”
রাজু কোনো কথা না বলে সাগরের দিকে চোখ লাল করে তাকাল, মানুষের চোখ দিয়ে যদি আগুন বের হওয়ার কোনো ব্যবস্থা থাকত তা হলে সাগর পুড়ে ছাই হয়ে যেত।
সাগর অবিশ্যি রাজুর ভয়ানক দৃষ্টিকে এতটুকু গ্রাহ্য করল না, আঙুল চাটতে চাটতে বলল, “তুমি দেখতে পর্যন্ত খারাপ। তুমি যখন রাগ হও তোমাকে দেখতে আরও খারাপ লাগে। থুঃ থুঃ থুঃ!”
রাজু রেগেমেগে বলল, “ভাগ এখান থেকে। জানে মেরে ফেলব।”
“এই দেখো তোমাকে দেখতে কত খারাপ লাগছে, থুঃ!” বলে সাগর ঘরের মেঝেতে সত্যি সত্যি একদলা থুতু ফেলে দিল।
রাজু আরেকটু হলে সাগরকে মার দেওয়ার জন্যে প্রায় ধরে ফেলছিল, কিন্তু হঠাৎ তার একটা কথা শুনে সে থমকে দাঁড়াল। সাগর বলল, “আব্বু-আম্মু যখন ঝগড়া করে তখন তাদের দেখতে যত খারাপ লাগে তোমাকে তার থেকে বেশি খারাপ লাগে।”
রাজু কয়েক মুহূর্ত সাগরের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে অবাক হয়ে বলল, “কী বললি?”