“রিমঝিম।”
“রিমঝিম কী সুন্দর নাম! আমরা তোমার চেহারাটা বদলে দিই, যেন তোমাকে তোমার আব্বু চিনতে না পারে।”
রিমঝিম ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “কীভাবে বদলাবে? আমার আম্মু যদি। আমাকে না চিনে?”
শাহানা হাসল, বলল, “আম্মুরা সব সময় তার ছেলে-মেয়েদের চিনতে পারে।”
টুনি দরজায় ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিল, এবারে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে রিমঝিমকে চুপ করতে বলল, তার আব্বু ফিরে আসছে।
নিচে কেউ নাই, তাই মানুষটা খুবই বিরক্ত মুখে উপরে উঠে এসেছে। দরজা খোলার জন্য পকেট থেকে প্রাস্টিকের কার্ডের চাবিটা বের করে স্লটে ঢোকানোর চেষ্টা করল, কার্ডটা ভেতরে পুরোপুরি ঢুকল না তাই দরজটাটা খুলল না। মানুষটা এবারে দরজাতে জোরে জোরে ধাক্কা দিয়ে ডাকল, “রিমঝিম! রিমঝিম!”
ভেতর থেকে কোনো শব্দ নেই। মানুষটার চেহারায় কেমন যেন ভয়ের ছাপ পড়ল। সে আরো কয়েকবার দরজায় ধাক্কা দিয়ে নিচে নেমে যায়।
এদিকে ঘরের ভেতরে শাহানা ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে রিমঝিমের চুল কেটে তাকে ছেলের মতো বানিয়ে ফেলল। তারপর তার ফ্রক বদলে একটা শার্ট আর প্যান্ট পরিয়ে দিল। পায়ে টেনিস শু। চেহারাটায় আরো পরিবর্তন আনার জন্য তখন টুনির চশমাটা পরিয়ে দিল। চশমাটা একটু ঢলঢলে হলো কিন্তু চেহারাটার মাঝে পরিবর্তনটা ঠিকই এলো। ঘরের মাঝে একটু ফুটবল ছিল, ফুটবলটা রিমঝিমের হাতে দিয়ে সবাই তাকে পরীক্ষা করল। তাকে দেখে এখন চেনার কোনো উপায় নেই, খুব ভালো করে লক্ষ না করলে কেউ তাকে চিনতে পারবে না।
টুনি দরজা ফাঁক করে বাইরে তাকিয়েছিল, এবারে ভেতরে তাকিয়ে বলল, “এখন কেউ নেই। রিমঝিম, চলো এখান থেকে বের হয়ে যাই।”
রিমঝিম ভয়ে ভয়ে বলল, “আবু যদি দেখে ফেলে?”
“দেখলেও তোমাকে চিনবেন না। তুমি শুধু কোনো কথা বলো না।”
“ভয় করে।” “কোনো ভয় নাই। করিডরে কেউ নাই। এসো আমরা যাই।”
শাহানা বলল, “শুধু ছোটদের নিয়ে যা টুনি।”
টুনি বলল, “ঠিক আছে।”
তারপর মুনিয়া, টুম্পা আর রিমঝিমকে নিয়ে টুনি বের হলো। রুম থেকে বের হয়ে মাত্র দুই পা গিয়েছে ঠিক তখন লিফটের দরজা খুলে গেল আর লিফটের ভেতর থেকে রিমঝিমের আব্বু বের হয়ে এলো। সাথে হোটেলের একজন মানুষ। দুজন একেবারে রিমঝিমের মুখোমুখি।
রিমঝিম ভয়ে দাঁড়িয়ে গেল, সে আর নড়তে পারছে না।
টুনি তখন তার পেছন ধাক্কা দিয়ে বলল, “চল, চল। দাঁড়িয়ে আছিস কেন? টুর্নামেন্ট শুরু করতে দেরি হয়ে যাবে।”
রিমঝিমের আব্বু ছোট দলটার ওপর চোখ বুলিয়ে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যায়, সাথের মানুষটাকে বলল, “আমার রুমের তালা খুলতে পারছি না–মেয়েটাও ভেতর থেকে কোনো কথা বলে না। কী যে হয়েছে।”
রিমঝিমের আব্বু, রিমঝিমকে চিনতে পারেনি।
হোটেলের মানুষটা বলল, “দেখছি। আমি দেখছি।”
টুনি অন্য তিনজনকে নিয়ে লিফটের সামনে দাঁড়াল। রিমঝিমের আব্বু আবার মাথা ঘুরিয়ে তাদের দিকে তাকাল। এখন রিমঝিমকে পেছন থেকে দেখছে, চিনতে পারার কথা না।
লিফটের বোম টিপে চারজন দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে। মনে হয় লিফটটা আসতে বুঝি অনন্তকাল পার হয়ে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত লিফট এসে থামল, দরজা খুলল। চারজন শান্ত ভঙ্গিতে ভেতরে ঢুকল তারপর দরজাটা বন্ধ হতেই সবাই একসাথে আনন্দে চিৎকার করে উঠে। রিমঝিমকে তার আব্বু আর ধরতে পারবে না।
লিফট থেকে বের হয়ে তারা ছুটতে ছুটতে সমুদ্রের দিকে যেতে থাকে।
.
এদিকে অনেক কষ্ট করে রিমঝিমের আব্বুর রুমটা খোলা হলো। ভেতরে ঢুকে মানুষটা চারিদিকে তাকাল, বাথরুমের ভেতর উঁকি দিল, তারপর বলল, “আমার মেয়ে কোথায়?”
একজন মানুষের ছোট একটি মেয়ে যদি হারিয়ে যায় তাহলে তার যেরকম অস্থির হয়ে যাওয়ার কথা, মানুষটি সেরকম অস্থির হলো না। কেমন যেন রাগী গলায় বলল, “মেয়েটিকে কে নিয়ে গেল?”
হোটেলের মানুষটা বলল, “নিচে চলেন, সিসি ক্যামেরাতে দেখি। হোটেলের বাইরে গেলে আমরা দেখে ফেলব।”
গত আধা ঘণ্টা সময়ে কারা কারা হোটেলে ঢুকছে কারা কারা বের হয়েছে। সবাইকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা হলো কিন্তু রিমঝিমের কোনো হদিস নেই। হোটেলের মানুষটা অবাক হয়ে দেখল, এরকম অবস্থায় মানুষটার দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে যাওয়ার কথা কিন্তু মানুষট দুশ্চিন্তিত না হয়ে আস্তে আস্তে কেমন জানি রেগে উঠছে। রেগে উঠছে কেন?
সমুদ্রের তীরে বালুবেলায় বাচ্চারা ছোটাচ্চুটি করে খেলছে। টুনির চশমা টুনিকে ফেরত দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত রিমঝিমের মনটা ভালো হয়েছে। তার আব্বু হঠাৎ করে এখানে চলে আসবে না কাজেই সে এখন কথাবার্তাও বলছে। শাহানা যেরকম বলেছিল তাই ঘটেছে। রিমঝিমের আম্মু আর আব্বুর মাঝে ডিভোর্স হয়ে গেছে, রিমঝিম তার আম্মুর সাথে থাকে। তার আব্বুর সেটা নিয়ে খুব রাগ। আম্মুকে শাস্তি দেওয়ার জন্যে তাকে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকক না মালদ্বীপ কোথায় জানি যাবে।
ঠিক এরকম সময় দেখা গেল কাজেম আলী চাচা বালুতে লম্বা লম্বা পা ফেলে হেঁটে আসছে। তার পেছনে শাড়ি পরা একজন ভদ্রমহিলা, উদ্বিগ্ন মুখে হেঁটে হেঁটে আসছেন।
বাচ্চারা দৌড়াদৌড়ি থামিয়ে তাদের দিকে তাকাল এবং হঠাৎ করে রিমঝিম ‘আম্মু আম্মু বলে চিৎকার করে মহিলার দিকে ছুটে যায়। মা বালুতে বসে দুই হাত বাড়িয়ে রাখলেন আর রিমঝিম ছুটতে ছুটতে তার বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার মেয়েটিকে এখন ছেলের মতো দেখাচ্ছে কিন্তু তার পরেও তার মায়ের চিনতে এতটুকু দেরি হলো না।