- বইয়ের নামঃ মেকু কাহিনী
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ অনুপম প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. জন্ম – মেকু কাহিনী
কী হল ব্যাপারটা মেকু ঠিক বুঝতে পারল না—প্রথমে টানা হ্যাঁচড়া চিৎকার হইচই তারপর হঠাত করে মনে হল কেউ যেন কুসুম কুসুম গরমের আরামের একটা জায়গা থেকে তাকে টেনে ঠাণ্ডা একটা ঘরে এনে ফেলে দিল। মেকু গলা ফাটিয়ে একটা চিৎকার দেবে কি না চিন্তা করল। কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক ভদ্রতা হবে না বলে মাড়িতে মাড়ি চেপে পুরো যন্ত্রণাটা সহ্য করে অপেক্ষা করতে থাকে। আশেপাশে কিছু উত্তেজিত গলা শোনা যেতে থাকে—মানুষগুলি কী নিয়ে এরকম খেপে গেছে দেখার জন্যে মেকু খুব সাবধানে চোখ খুলে তাকাতেই প্রচণ্ড আলোতে তার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। মেকু তাড়াতাড়ি চোখ বন্ধ করল, কী সর্বনাশ! এত আলো কোথা থেকে এসেছে?
চারপাশের লোকজন এখনো খুব চেঁচামেচি করছে, মনে হচ্ছে কিছু একটা নিয়ে ভয় পেয়েছে। কী নিয়ে ভয় পেয়েছে কে জানে। মেকু শুনল কেউ একজন বলল, “কী হল? বাচ্চা কাঁদে না কেন?”
কোন বাচ্চার কথা বলছে কে জানে! বাচ্চা কান্নাকাটি না করাই তো ভালো, এটা নিয়ে ভয় পাওয়ার কী আছে? কোন বাচ্চা কাঁদছে না মেকু সেটা চোখ খুলে একবার দেখবে কি না ভাবল কিন্তু চোখ ধাঁধানো আলোর কথা চিন্তা করে আর সাহস পেল না। শুনতে পেল ভয় পাওয়া গলায় মানুষটা আবার বলল, “সর্বনাশ! বাচ্চা যে এখনো কাঁদছে না!”
মোটা গলায় একজন বলল, “বাচ্চাটাকে উলটো করে ধরে পাছায় জোরে থাবা দাও।”
কোন বাচ্চার কপালে এই দুর্গতি আছে কে জানে। ছোট একটা বাচ্চাকে উলটো করে ধরে তার পাছায় থাবা দিয়ে কাঁদিয়ে দেওয়া কোন দেশী ভদ্রতা? এরা কি ধরনের মানুষ? মেকু চোখ খুলে এই বেয়াদব মানুষগুলিকে এক জনরে দেখবে কী না ভাবল, তার আগেই হঠাত করে কে যেন তার দুই পা ধরে তাকে চ্যাং দোলা করে উপরে তুলে ফেলল। তারপর উলটো করে ঝুলিয়ে কিছু বোঝার আগেই প্রচণ্ড জোরে তার পাছায় একটা ভয়াবহ থাবড়া মেরে বসে। মেকুর মনে হল শুধু তার পাছা নয় শরীরের হাড়, মাংস, চামড়া সবকিছু চিড়বিড় করে জ্বলে উঠেছে।
ভয় পাওয়া মানুষটা এবারে চিৎকার করে উঠল, “কী সর্বনাশ! এখনো দেখি কাঁদছে না।”
মেকু প্রাণপণে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু যে ধরেছে তার হাত লোহার মতো শক্ত, সেখান থেকে ছাড়া পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। কিছু বোঝার আগেই শক্ত লোহার মতো হাত দিয়ে আবার তার পাছায় কেউ একজন একটা ভয়াবহ থাবড়া বসিয়ে দিল, সেই থাবড়া খেয়ে মেকুর মনে হল তার শরীরের ভিতর সবকিছু বুঝি ওলট পালট হয়ে গেল। হঠাত করে মেকু বুঝতে পারল যে বাচ্চাটা কাঁদছে না বলে সবাই খুব ভয় পেয়ে গেছে সেই বাচ্চাটা সে নিজে, এবং যতক্ষণ সে তার গলা ছেড়ে বিকট গলায় কাঁদতে শুরু না করবে ততক্ষণ শক্ত লোহার হাত দিয়ে তার পাছায় একটার পর একটা থাবড়া মারতেই থাকবে।
মেকু আর দেরি করল না, গলা ফাটিয়ে বিকট গলায় চিৎকার করে কেঁদে উঠল, সাথে সাথে ঘরে একটা আনন্দধ্বনি শোনা যায়। মোটা গলায় মানুষটা বলল, “আর ভয় নাই। বাচ্চা কেঁদেছে।”
ভয় যখন নেই এখন কাঁদা থামাবে কিনা মেকু বুঝতে পারল না। কিন্তু শেষে সে কোনো ঝুঁকি নিল না, চোখ পিট পিট করে তাকাতে তাকাতে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগল। মোটা গলার মানুষটা খুশি খুশি গলায় বলল, “ওয়ান্ডারফুল! কী চমৎকার কাঁদছে দেখ। কী শক্ত লাংস!”
মেকু বুঝতে পারল না কাঁদা কেমন করে চমৎকার হয় আর তার সাথে শক্ত লাংসের কী সম্পর্ক। সে শক্ত হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। এতদিন মায়ের পেটে কী আরামে ছিল, খাওয়ার চিন্তা নেই, ঘুমানোর চিন্তা নেই, বাথরুম যাবার সমস্যা নেই, আর সেখান থেকে বের হতে না হতেই এ কী সমস্যা?
মেকু টের পেল কেউ একজন তাকে আচ্ছা করে দলাই মলাই করে মুছোমুছি করছে। শরীর মুছে একটা কাপড়ে জড়িয়ে ধরে মেয়েলি গলায় কেউ একজন জিজ্ঞেস করল, “দেব এখন মায়ের কাছে?”
মেকু প্রায় চিৎকার করে বলেই ফেলছিল, “দেবো না মানে? এক শ বার দেবে—” কিন্তু এখানকার ব্যাপার-স্যাপার ভালোমতো না বুঝে কিছু বলা উচিত হবে বলে মনে হয় না। মেকু চুপ করে রইল, শুনল ভারী গলায় একজন বলছে, “না এখন মায়ের কাছে দেবেন না। মা খুব টায়ার্ড। পাজি ছেলেটার ডেলিভারিতে মায়ের কী কষ্ট হয়েছে দেখছেন না?”
মেকু খুব চটে উঠল, তাকে পাজি বলছে কত বড় সাহস? রেগেমেগে সে কিছু একটা বলেই ফেলছিল কিন্তু লোহার মতো শক্ত হাতের সেই ভয়ংকর থাবড়ার কথা মনে করে চুপ করে রইল। চোখ পিট পিট করে সে মানুষটাকে এক নজর দেখে নিল, শুকনো মতন একজন মানুষ, মাথায় কাঁচাপাকা চুল, নাকের নিচে ঝাঁটার মতো গোঁফ।
গোলগাল মোটা সোটা একজন নার্স মেকুকে বুকে জড়িয়ে ধরে হেসে বলল, “হি হি হি ডাক্তার সাহেব দেখছেন? কেমন চোখ কটমট করে আপনার দিকে তাকাচ্ছে। মনে হচ্ছে আপনি পাজি বলেছেন, সেটা বুঝতে পেরেছে!”
শুকনো মতন মানুষটা—যার গোঁফের নিচে ঝাঁটার মতো গোঁফ মাথা নেড়ে বলল, “ঠিকই বলেছ! এই ছেলে জন্মের সময় মা’কে যত কষ্ট দিয়েছে মনে হচ্ছে সারা জীবনই কষ্ট দেবে!”
মেকু কিছু না বলে চুপ করে শুয়ে রইল। সত্যিই সে মা’কে কষ্ট দিয়েছে নাকি? সে ইতি উতি করে দেখার চেষ্টা করল, মা মনে হয় পাশের বিছানায় নেতিয়ে শুয়ে আছে। এখান থেকে ঝাঁপিয়ে মায়ের বুকে পড়ার ইচ্ছে করছে কিন্তু তাকে যেতে দেবে বলে মনে হয় না। ঝাঁটার মতো গোঁফের ডাক্তার বলল, “বাচ্চাটাকে নিয়ে নার্সারিতে রাখেন, মা খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিক।”