এভাবে কয়েক ঘণ্টা কেটে যায়। পানিতে ভিজে ভিজে সবার চোখ লাল, হাতের আঙুল শুকনো কিসমিসের মতো। বিকেল হয়ে আসছে তাই একটু একটু ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করেছে। কাজেম আলী চাচা এক সময় ঘুম থেকে উঠে সবাইকে ডাকল, বলল, “উঠে এসো সবাই। হোটেলে ফিরে নাশতা করবে, তারপর আবার সূর্যাস্ত দেখতে আসব।”
‘নাশতা নাশতা, সূর্যাস্ত সূর্যাস্ত’ বলে চিৎকার করতে করতে সবাই এবারে উঠে আসতে শুরু করে।
.
ঘণ্টাখানেক পরে সূর্য যখন ঢলে পড়েছে তখন সবাই আবার সমুদ্রতীরে ফিরে এলো। পুরো জোয়ার এসেছে বলে পানি এসে বালুবেলাটা প্রায় ভরে ফেলেছে। দুপুরের তুলনায় এখন মানুষ অনেক বেশি এবং সবাই মোটামুটি সেজেগুঁজে আছে। একটু ঠাণ্ডা পড়েছে বলে খুব বেশি মানুষ পুরোপুরি পানিতে নামেনি। কাজেম আলী চাচা আবার একটা বিচ চেয়ারে বসেছে, কিছুক্ষণ পর সে সেখানে শুয়ে গেল এবং আরো কিছুক্ষণের মাঝে তার নাক ডাকতে লাগল! এই মানুষটার ঘুমানোর ক্ষমতা রীতিমতো অসাধারণ।
সূর্যটা আস্তে আস্তে আরো নিচে নামতে থাকে, এটাকে এখন ডিমের কুসুমের মতো দেখায়। শান্ত হা করে সেটা খেয়ে ফেলছে সেরকম একটা ছবি তোলার পর সবাই হি হি করে হাসতে হাসতে এরকম আরো ছবি তুলতে লাগল। মুনিয়া যখন তার ছবিটা তুলছে ঠিক তখন দেখল মারা যাওয়া ছোট মেয়েটি আর তার বাবা সমুদ্রের তীর ধরে হাঁটছে।
মেয়েটির চেহারায় একই সাথে দুঃখ আর ভয়। মুনিয়া খুবই মিশুক মেয়ে, সে ছবি তোলা বন্ধ করে সাথে সাথে মেয়েটার কাছে ছুটে গিয়ে কথা বলতে শুরু করে “আপু! তুমি এসেছ?”
মেয়েটি কোনো কথা না বলে মুনিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। মুনিয়া বলল, “আমরা সূর্যটা খেয়ে ফেলছি এরকম ছবি তুলছি। তুমি তুলবে?”
মেয়েটি এবারেও কোনো কথা বলল না।
মুনিয়া বলল, “তুমি আসবে আমাদের সাথে? চল আমরা পানির ওপর দিয়ে হাঁটি?”
মেয়েটা তার বাবার মুখের দিকে তাকাল, বাবা সাথে সাথে মুখটা কেমন যেন শক্ত করে ফেলল। সেটা দেখে মেয়েটার মুখটাও কেমন যেন হয়ে গেল। সে মুনিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল, কিন্তু কোনো কথা বলল না। বাবা তখন মেয়েটার হাত ধরে একটু টান দিয়ে তাকে নিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করে দেয়। হাঁটতে হাঁটতে মেয়েটা কয়েকবার পেছন ফিরে তাকাল, সবাই দেখল তার চোখটা কেমন জানি ছল ছল করছে।
বাবা আর মেয়েটা মানুষের ভিড়ে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া পর্যন্ত সবাই সেদিকে তাকিয়ে রইল। তারপর সবাই একসাথে লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলল। মুনিয়া বলল, “তোমরা দেখেছ বাবাটা কত খারাপ?”
শাহানা বলল, “হ্যাঁ। একটু রবোট টাইপ।”
প্রমি বলল, “রবোট না, পাষণ্ড টাইপ।”
মুনিয়া বলল, “মায়ের কাছ থেকে মেয়েটাকে কেড়ে এনেছে। কত খারাপ কত নিষ্ঠুর।”
সবাই মুনিয়ার দিকে তাকাল, আগেরবার যখন মুনিয়া এই কথা বলেছে। তখন কেউ সেটাকে গুরুত্ব দেয় নাই। এবারে কেন জানি অনেকেরই মনে হলো, হতেও তো পারে।
টুনি বলল, “ইচ্ছা করলে আমরা সেটা বের করতে পারি।”
শান্ত জিজ্ঞেস করল “কী বের করবি?”
“বাবা মেয়েটাকে কিডন্যাপ করে এনেছে কি না।”
শাহানা বলল, “ডিভোর্স হলে কোর্ট অনেক সময় বাচ্চা মা’কে দিয়ে দেয়, তখন বাবারা মাঝে মাঝে বাচ্চা কিডন্যাপ করে নিয়ে অন্য দেশে পালিয়ে যায়।”
শান্ত ভুরু কুচকে বলল, “এই বাবাটাও তাই করছে?”
টুনি বলল, “আমরা জানি না। কিন্তু বের করে ফেলা যায়।”
এবারে প্রায় সবাই একসাথে জিজ্ঞেস করল, “কীভাবে বের করবি?”
টুনি বলল, “যদি আসলেই মা বেঁচে আছে তাহলে মা নিশ্চয়ই অনেক খোজাখুজি করছে। খুঁজতে খুঁজতে যদি এখানে চলে আসে তাহলে বাবাটা নিশ্চয়ই ঝামেলায় পড়বে।”
“কিন্তু মা জানবে কেমন করে যে বাচ্চাটা এখানে আছে?”
“জানবে না। কিন্তু যদি বাবাটাকে জানানো হয় যে ঢাকা থেকে একজন ভদ্রমহিলা এসে একজন বাবা আর তার সাথে ছোট একটা মেয়েকে খুঁজে বেড়াচ্ছে তাহলে বাবাটা নিশ্চয়ই অনেক ঘাবড়ে যাবে।”
কেউ কোনো কথা বলল না, কিন্তু সবাই মাথা নাড়ল।
টুনি বলল, “কিন্তু আসলেই যদি মা মারা গিয়ে থাকে তাহলে বাবা ঘাবড়ে যাবে না, মনে করবে অন্য কোনো মহিলা অন্য কাউকে খুঁজছে।”
এবারেও সবাই মাথা নাড়ল, টুম্পা বলল, “টুনি আপু তোমার মাথায় অনেক বুদ্ধি।”
টুনি বলল, “কিন্তু খালি বুদ্ধি দিয়ে তো হবে না। বাবাটাকে এই খবরটা কে দেবে? আমরা দিলে তো ঠিক হবে না বাবাটা আমাদের দেখেছে। বড় কোনো মানুষকে খবরটা দিতে হবে।”
সবাই ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল। ছোটাছু বলল, “বাবাটা আমাকে তোদের সাথে দেখেছে। তা ছাড়া জেনে-শুনে এভাবে মিথ্যা কথা বলা সোজা না।”
শাহানা জিজ্ঞেস করল, “তাহলে কে বলবে?”
“আমি বলব। কাজেম আলী চাচার গলার স্বর শুনে সবাই একেবারে চমকে উঠল। বিচ চেয়ারে যেখানে কাজেম আলী চাচা নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছিল তারা তার পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। কাজেম আলী চাচা যে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তাদের কথা শুনছে তারা সেটা চিন্তাও করে নাই।
শাহানা বলল, “আপনি বলবেন?”
কাজেম আলী চাচা চোখ খুলল, “হ্যাঁ। কেসটা আমার কাছে ভালো লাগছে। কিছু একটা করা দরকার।”
“কখন বলবেন?”
“এই তো আজকেই। মানুষটাকে হোটেলে পেলেই বলব।”
টুনি বলল, “থ্যাংকু কাজেম আলী চাচা। যখন ছোট মেয়েটা সাথে নাই তখন বলতে হবে।”