মুনিয়া তবু হাল ছাড়ল না। বাচ্চা মেয়েটাকে ডেকে বলল, “আমরা সমুদ্রে গোসল করতে যাচ্ছি। তুমি আসবে আমাদের সাথে?”
মেয়েটা কিছু বলল কী না শোনা গেল না। ততক্ষণে বাবাটা তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে রেস্টুরেন্টের ভেতর ঢুকে গেছে।
রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে সবাই সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে। কেউ কোনো কথা বলছে না। এত ছোট একটা মেয়ের মা মারা গেছে মেয়েটা কোনোভাবেই সেটা মেনে নিতে পারছে না, বেচারা বাবা মেয়েটাকে কোনোভাবে শান্ত করতে পারছে না, পুরো ব্যাপারটা দেখে সবারই কেমন যেন মন খারাপ হয়ে যায়।
.
হোটেল থেকে বের হয়ে যখন তারা সমুদ্রের বালুবেলায় পা দিয়েছে তখন প্রমি একটি নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “বেচারি মেয়েটা, আহারে। এত ছোট? এখনই মা মারা গিয়েছে।”
মুনিয়া কাছাকাছি ছিল, সে হঠাৎ করে চিৎকার করে বলল, “না মারা যায় নাই।”
“মারা যায় নাই?”
“না।” মুনিয়া মুখে শক্ত করে বলল, “শোন নাই তোমরা মেয়েটা বলেছে তার আম্মু মারা যায় নাই?”
শান্ত ভুরু কুচকে বলল, “তুই বলছিস তার বাবা মিথ্যা কথা বলছে?”
“হ্যাঁ।” মুনিয়া জোরে জোরে মাথা নাড়ল।
“তাহলে তার মা কই?”
মুনিয়া বলল, “বাসায়। বাবা মেয়েটাকে জোর করে নিয়ে এসেছে।”
“কেন?”
“বাবাটা খারাপ মানুষ।”
শান্ত অবাক হয়ে বলল, “খারাপ মানুষ?”
“হ্যাঁ।”
“তুই কেমন করে জানিস?”
মুনিয়া মুখ শক্ত করে বলল, “আমি জানি চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। বাবার চোখগুলো দেখো নাই, কী রকম জানি নিষ্ঠুর।”
শান্ত শব্দ করে হাসল, বলল, “মুনিয়া, তোর মাথায় গোলমাল আছে।”
মুনিয়া চিৎকার করে বলল, “না, আমার মাথায় গোলমাল নাই।”
অন্যেরা তখন মুনিয়াকে শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকে। প্রথমবার নিজের আম্মু-আব্বুকে রেখে একা একা এসেছে, তারই বয়সী একজন মেয়ের আম্মু নেই সেটা সে এখন চিন্তাই করতে পারে না!
গরম বালুর ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শুধু টুনি চিন্তা করতে থাকে, এমন কী হতে পারে মুনিয়ার ধারণাটাই সত্যি? বাবাটা আসলেই নিজের মেয়েকে মায়ের কাছ থেকে জোর করে সরিয়ে এনেছে? আসলে মা মারা যায়নি। এটা এক ধরনের কিডন্যাপ? কিন্তু নিজের বাবা কী কখনো নিজের বাচ্চাকে কিডন্যাপ করে? টুনি জোর করে মাথার ভেতর থেকে চিন্তাটা দূর করে দেওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু কেন জানি সেটা দূর হলো না। মাথার ভেতরে ঘুরঘুর করতে লাগল।
সমুদ্রের তীরের বালু যথেষ্ট গরম তার ওপর দিয়ে সবাই তাড়াহুড়া করে দৌড়াতে দৌড়াতে একেবারে পানির কাছে চলে এলো। বড় বড় সমুদ্রের ঢেউ আসছে, তার মাঝে অনেকে ঝাপাঝাপি করছে। মুনিয়া জিজ্ঞেস করল, “আমরা কি পানিতে নামব?”
শান্ত হুংকার দিয়ে বলল, “পানিতে না নামলে সমুদ্রে এসেছি কেন?” তারপর জুতো-শার্ট খুলে হাতের ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে পানির দিকে ছুটে যেতে থাকে।
মুনিয়া ভয়ে ভয়ে বলল, “জোয়ার কী শুরু হয়েছে?”
কাজেম আলী বলল, “হ্যাঁ। জোয়ার শুরু হয়েছে। তোমরা পানিতে নামতে পার। তোমাদের জিনিসপত্র রেখে যাও। আমি দেখব।”
সবাই তখন হইচই করে জামা-জুতো খুলে ব্যাগ রেখে সমুদ্রের ঢেউয়ের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কাজেম আলী সমুদ্রের তীরে রাখা সারি সারি বিচ চেয়ারের একটার ওপর তাদের সবার জিনিসপত্র রেখে পাশের বিচ চেয়ারে শুয়ে পড়ে এবং দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে যায়। মনে হচ্ছে এই মানুষটা ঘুমানোর মাঝে এক্সপার্ট।
মুনিয়া ভয়ে ভয়ে পানির কাছে এগিয়ে যায়। বড় বড় ঢেউ এসে তীরে ভেঙ্গে পড়ছে, মুনিয়া কাছাকাছি দাঁড়িয়ে সেগুলো দেখে। ঢেউগুলো এসে তার পা ভিজিয়ে দিচ্ছিল। ঢেউগুলো ফিরে যাবার সময় পায়ের নিচ থেকে বালু সরিয়ে নিতে থাকে, তখন কেমন যেন সুড়সুড়ি লাগতে থাকে। টুনি কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল, বলল, “আরো একটু বেশি পানিতে যাবি?”
মুনিয়া রাজি হলো। টুনির হাত ধরে সে সাবধানে হাঁটু পানি থেকে কোমরে পানি, কোমর পানি থেকে বুক পানিতে নেমে এল। ঠিক তখন কোথা থেকে জানি বিশাল একটা ঢেউ এসে মুনিয়ার মাথার ওপর দিয়ে চলে যায়। টুনির হাত থেকে মুনিয়ার হাত ছুটে গেল, বিশাল ঢেউয়ের ধাক্কায় সে একেবারে তীরে এসে আছাড় খেয়ে পড়ল। তার নাক-মুখ দিয়ে পানি ঢুকে একেবারে বিতিকিচ্ছি অবস্থা–প্রথমে মনে হলো সে বুঝি মরেই গেছে, পানি সরে যাবার পর বুঝতে পারল আসলে মরে যায় নাই। তারপরও সে একটু কেঁদে ফেলবে কি না বুঝতে পারছিল না, শেষ পর্যন্ত কাঁদল না। কিন্তু পানি থেকে সরে এসে সে বালুর মাঝে বসে রইল। টুনি টুম্পা প্রমি সবাই এসে ডাকাডাকি করল কিন্তু সে আর পানিতে নামার সাহস পেল না।
বালুর মাঝেও কত কি দেখার আছে। কত রকম ঝিনুক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, একটা তারা মাছ তির তির করে নড়ছে। সবচেয়ে মজার জিনিস হচ্ছে ছোট ছোট কাকড়া, ছোট ছোট গর্ত থেকে মাথা বের করে উঁকি দেয়, তারপর সাবধানে বের হয়ে ব্যস্ত হয়ে ছোটাচ্চুটি করতে থাকে। একটু ভয় দেখালেই সবগুলো আবার ছুটে গর্তে ঢুকে যায়! কী মজা লাগে দেখতে।
মুনিয়াকে একা বসে থাকতে দেখে টুনি তার পাশে এসে বসল। দুজনে মিলে ভিজে বালু দিয়ে খেলতে থাকে। বালু দিয়ে একটা ঘর বানাল। একটা কুমির বানাল, লম্বা একটা সাপ বানাল। ঢেউ এসে এক সময় সেগুলোও ভাসিয়ে নিয়ে গেল।