দেখতে দেখতে চাঁদরটা নানা জিনিসপত্রে বোঝাই হয়ে উঠল, তখন ঝুমু খালা চাঁদরটাতে বেঁধে সব জিনিসপত্র একেবারে বাইরে নিয়ে ঢেলে এলো। তারপর আবার চাঁদরটা বিছানো হলো, আবার এর ওপর জিনিসপত্রগুলোকে বিদায় দিয়ে দিয়ে রাখা হলো। দেখতে দেখতে আবার সেই চাঁদরটা বোঝাই হয়ে গেল। ঝুমু খালা তখন আবার চাঁদরটা বাইরে খালি করে আবার ফিরে এলো। এইভাবে চলতেই থাকল।
সন্ধ্যেবেলা বুড়ি নানির ছেলে যখন ছোটাচ্চুকে নিয়ে ঝুমু খালা আর টুনিকে নিতে এলো তখন সে গাড়িটা ভেতরে ঢোকাতে পারল না, কারণ বাইরের পুরো জায়গাটা জিনিসপত্রের স্থূপে বোঝাই হয়ে আছে। গাড়ি বাইরে রেখে ছোটাচ্চু বুড়ি নানির ছেলের সাথে ভেতরে ঢুকে চোখ কপালে তুলে বলল, “এখানে কী হচ্ছে?”
টুনি বলল, “ঝুমু খালার বাসা পরিস্কার প্রজেক্ট।”
ছোটাচ্চু বলল, “বাসা পরিষ্কার প্রজেক্ট? ঝুমুর না চিঠি খুঁজে বের করার কথা?”
টুনি এক গাল হেসে বলল, “চিঠি অনেক আগে বের করা হয়ে গেছে।”
ছোটাচ্চু চিৎকার করে বলল, “চিঠি বের করা হয়ে গেছে?”
ছোটাচ্চুর চিৎকার শুনে বুড়ো নানির ছেলে এগিয়ে এল। টুনি তার হাতে চিঠিটা দিয়ে বলল, “দেখবেন, এটাই সেই চিঠি নাকি?”
মানুষটি খাম খুলে ভেতরে এক নজর দেখেই আনন্দে চিৎকার করে বলল, “হ্যাঁ। এইটাই সেই চিঠি। কী আশ্চর্য!”
ছোটাচ্চু বলল, “আমি ভেবেছিলাম চিঠিটা লাল রংয়ের খামে হবে।”
টুনি বলল, “সবাই তাই ভেবেছিল তাই কেউ কোনোদিন খুঁজে পায় নাই।”
“মানুষটা মাথা নেড়ে বলল, খামটা যদি লাল না হয়ে থাকে তাহলে মা লাল খাম লাল খাম বলছিল কেন?”
টুনি বলল, “আমি বইয়ে পড়েছি। মানুষ সবসময় এরকম করে। দেখে একটা বলে আরেকটা।”
ছোটাচ্চু অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, “কী আশ্চর্য!”
সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছিল বলে টুনি ছোটাচ্চর সাথে বাসায় চলে এলো। চিঠিটা খুঁজে পাওয়া গেছে বলে ছোটাচ্চুর মেজাজ খুবই ভালো। ঝুমু খালা তাদের সাথে এলো না, তার বাসায় ফিরতে অনেক রাত হলো। পঞ্চাশ বছরের বাসা এক রাতে খালি করা সোজা কথা না!
.
দুদিন পর সন্ধেবেলা বাসায় দরজায় বেল বেজেছে। টুম্পা দরজা খুলে দেখে একজন ফর্সা মানুষ হাতে মিষ্টির বাক্স নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটি বুড়ি নানির ছেলে। টুম্পাকে দেখে হাসি হাসি মুখে বললেন, “শাহরিয়ার সাহেব বাসায় আছেন?”
টুম্পা ভুরু কুচকে বলল, “শাহরিয়ার সাহেব?”
“হ্যাঁ। ঐ যে বিখ্যাত ডিটেকটিভ?”
“ও। ছোটাচ্চু!”
টুম্পা মানুষটিকে সোফায় বসিয়ে ছোটাচ্চুকে ডেকে আনতে গেল।
ছোটাচ্চু তার ময়লা গেঞ্জিটার ওপর পরিষ্কার একটা শার্ট পরে বসার ঘরে হাজির হলো, মানুষটাকে দেখে হাসি হাসি মুখে বলল, “আরে! আপনি? কী মনে করে?”
মানুষটি বলল, “আমাদের সব রকম ঝামেলা মিটে গেছে তাই ভাবলাম আপনাকে একটা থ্যাংকস দিয়ে যাই। তার সাথে জিনিস খুঁজে বের করার স্পেশাল প্রফেশনাল ঝুমুকেও একটা থ্যাংকস–আমার মায়ের বাসাটা খালি করে দেবার জন্যে! উনাকে একটা গোল্ড মেডেল দেওয়ার কথা ছিল। ভাবলাম মেডেলের বদলে একটা চেক দিই। নিজে গিয়ে মেডেল কিনে নিবেন। উনি কোথায় থাকেন জানি না, উনার চেকটা আপনার কাছে নিয়ে এসেছি।”
বাসায় কেউ এসে ছোটাচ্চুর সাথে কথা বললে অন্যরা জানালার নিচে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে সেই কথাবার্তা শোনার চেষ্টা করে।
ঝুমু খালার জন্য একটা চেক আছে শুনে বাচ্চাদের উত্তেজনা থামিয়ে রাখা গেল না, তারা একটা গগনবিদারী চিৎকার দিল!
ছোটাচ্চু বললেন, “ঝুমু আমাদের সাথেই থাকে। আমি ডাকছি আপনি নিজের হাতে দেন, ও খুশি হবে।”
ঝুমু খালার চেক নিতে আসতে একটু দেরি হলো, কারণ সে তার ফেবারিট গোলাপি শাড়ি পরে এলো, চুলগুলো বেঁধে নিতে হলো এবং কপালে একটা টিপ দিল। চেক হস্তান্তরের সময় সব বাচ্চারা ঝুমু খালার পাশে থাকল এবং অনেকগুলো ছবি তোলা হলো। ঝুমু খালা চেকটা হাতে নিয়ে পরিমাণটা দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, “আংকেল ভুলে শূন্য একটা বেশি দিছেন মনে হয়!”
মানুষটি হাসি মুখে বলল, “না, শূন্য বেশি দিইনি। ঠিকই আছে।”
ঝুমু খালা কিছুক্ষণ হা করে চেকটার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর জিজ্ঞেস করল, “নানি কেমন আছেন?”
মানুষটি বলল, “ভালো আছেন। বাসা খালি হওয়ায় এখন হাঁটা-চলা করা যায়। শুধু একটা বিচিত্র ব্যাপার–”
“কী বিচিত্র ব্যাপার?”
“মা এখন দিন-রাত জিনিসপত্রের সাথে কথা বলেন। সেদিন মায়ের সাথে খেতে বসেছি। টেবিলে আলুর ভর্তা ছিল। মা আলু ভর্তা প্লেটে নিয়ে সেটাকে বলতে থাকলেন, “ভাই আলু তুমি কেমন আছ? মন মেজাজ ভালো? তোমাকে টিপে টিপে এরকম ভর্তা করে দিয়েছে সেইজন্যে আমি খুবই দুঃখিত।”
বাচ্চারা অনেক কষ্ট করে হাসি চেপে রাখল। তখন মানুষটা বলল, “সেদিন পাবদা মাছ খেতে দিয়েছি। মা একটা পাবদা মাছ মুখের কাছে নিয়ে বলতে থাকেন, ভাই মাছ, তুমি এইভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছ কেন। এইভাবে ড্যাব ড্যাব করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলে আমি তোমাকে খাব কেমন করে?”
বাচ্চারা এবারে আর পারল না, সবাই হি হি করে হাসতে শুরু করে দিল!