ঝুমু খালা মাথা নাড়ল। হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল, “এই মোটা ইন্দুর। কুচকুচা কালা।” ঝুমু খালা হাত দিয়ে উঁদুরের যে সাইজটা দেখিয়েছে সেই সাইজের বিড়াল হতে পারে, ইঁদুর হওয়া সম্ভব না।
ঝুমু খালা পিতলের বড় ফুলদানিটা হাতে অস্ত্রের মতো ধরে রেখে এদিক সেদিক সতর্কভাবে তাকাতে তাকাতে বলল, “এই বাসায় ইন্দুর আছে তার মানে কী বুঝছেন নানি?”
ভদ্রমহিলা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “মানে কী?”
“তার মানে হচ্ছে এই বাড়িতে সাপও নিশ্চয়ই আছে।”
“সাপ।”
“হে।” ঝুমু খালা মাথা নাড়ল। বলল, “যে বাড়িতে ইন্দুর থাকে সেই বাড়িতে সাপ থাকে। আর যে বাড়িতে সাপ থাকে সেই বাড়িতে বেজী থাকে। সে বাড়িতে বেজি থাকে সেই বাড়িতে শিয়ালও থাকতে পারে।”
বয়স্কা ভদ্রমহিলাকে কেমন জানি অসহায় দেখায়। কাঁপা গলায় বললেন, “কী বলছ এইসব?”
ঝুমু খালা হাতের ফুলদানিটা অস্ত্রের মতো ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলল, “নানি, আপনি এই বাড়ি পরিষ্কার করেন। তা না হলে–”
“তা না হলে কী?”
“আপনি রাত্রে যখন ঘুমাবেন। তখন এই মোটকা মোটকা ভোটকা ভোটকা কালা কালা ইন্দুর আইসা আপনার হাতের আঙুল, পায়ের আঙুল কামড়াইয়া কামড়াইয়া খায়া ফালাইব। সকালে উইঠা দেখাবেন হাতের দুইটা আঙুল নাই।”
বয়স্কা ভদ্রমহিলা ঝুমু খালার এরকম ভয়ংকর বর্ণনা শুনে কী রকম জানি শিউরে উঠলেন।
ঝুমু খালা নির্দয়ের মতো বলতে থাকল, “প্রথমে একটা দুইটা ইন্দুর আসব। তারপর আট-দশটা। তারপর এক রাত্রে শত শত কালা কালা ইন্দুর কিলবিল কিলবিল কইরা আপনার ওপর ঝাঁপায়া পড়ব।” কীভাবে ঝাঁপিয়ে পড়বে ঝুমু খালা সেটা অভিনয় করে দেখাল, সেটা দেখে টুনিও রীতিমতো শিউরে উঠল।
ভদ্রমহিলা কাঁপা গলায় বললেন, “পরিষ্কার তো করতে চাই, কিন্তু—”
“কিন্তু কী?”
“এত জিনিস হয়ে গেছে এখন কোন দিক দিয়ে কী পরিষ্কার শুরু করব বুঝে উঠতে পারি না।”
ঝুমু খালা এইবার বুকে একটা থাবা দিয়ে বলল, “আমার ওপর ছাইড়া দেন।”
“তোমার ওপর ছেড়ে দেব?”
“জে। আমার ওপরে ছাইড়া দেন। আমি আপনারে দেখাই কেমন করে এই খুচরা মাল দূর করতে হয়।”
“তুমি দেখাবে?”
“জী। আপনে বিছানার ওপর বালিশ ঠেস দিয়া বসেন।”
ভদ্রমহিলা বুড়ি নানি ঝুমু খালার কথামতো বিছানার ওপর বালিশে ঠেস দিয়ে বসল। ঝুমু খালা তখন নিচু হয়ে একটা চাঁদর টেনে বের করে এনে সেটা কোনোভাবে মেঝেতে বিছিয়ে নিল। তারপর এদিক-সেদিক তাকিয়ে ঘরের মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য জিনিসের মাঝ থেকে একটা শাড়ি বের করে এনে বুড়ি নানিকে দেখিয়ে বলল, “এই শাড়িটা আপনি শেষ বার কুনদিন পরেছেন?”
ভদ্রমহিলা মাথা চুলকালেন, বললেন, “মনে করতে পারছি না। অনেক আগে হবে।
“আবার কুনদিন পরবেন? আজকে? কালকে?”
“না, না, এখন পরব না।”
“তাহলে এরে বিদায় দেন।”
ভদ্রমহিলা অবাক হয়ে বললেন, “বিদায় দেব?”
“হ্যাঁ। শাড়িটা বুক চেপে ধরে বলেন, আমার আদরের শাড়ি! তোমাকে কতদিন পরছি। এখন তোমারে বিদায়। যেখানে থাকো সুখে থাকো আমার প্রিয় শাড়ি।”
বুড়ি নানি চোখ বড় বড় করে ঝুমু খালার দিকে তাকিয়ে রইল। ঝুমু খালা
রীতিমত ধমক দিয়ে বলল, “বলেন।”
বুড়ি নানি একটু ভয় পেয়ে বিড় বিড় করে বললেন, “আমার প্রিয় শাড়ি, তোমাকে কতদিন পরেছি। এখন তোমাকে বিদায়।”
ঝুমু খালা মনে করিয়ে দিল, “যেখানে থাকো, সুখ থাকো।”
ভদ্রমহিলা বললেন, “যেখানো থাকো সুখে থাকো।”
ঝুমু খালা তখন শাড়িটা মেঝেতে বিছানা চাঁদরের মাঝে ছুঁড়ে ফেলে নিচ থেকে একটা ফুলদানিতে তুলে নিল। ভদ্রমহিলাকে দেখিয়ে বলল, “এই ফুলদানি আপনি কুনদিন ব্যবহার করছেন?”
“অনেক আগে।”
“এখন আবার ব্যবহার করবেন?”
“না।“
“তাহলে এইটারেও বিদায় দেন। একটা চুমা দিয়ে বিদায় দেন। বলেন সোনার চান ফুলদানি বিদায়।”
বয়স্ক মহিলা সোনার চান ফুলদানি বলে চুমা দিয়ে ফুলদানিকে বিদায় দিলেন। ঝুমু খালা ফুলদানিটাকে চাঁদরের উপর ফেলে দিল। এবারে নিচ থেকে একটা টেবিল ল্যাম্প তুলে নিল। সেটা বুড়ি নানির হাতে দিয়ে ঝুমু খালা জিজ্ঞেস করল, “এইটা? এই টেবিল ল্যাম্পটা কী ব্যবহার করবেন?”
বুড়ি নানি মাথা চুলকে বলল, “ঘরে এত ল্যাম্প লাইট–এইটা আর কেমন করে ব্যবহার করব?”
“তাহলে এইটারেও বিদায় দেন, ভালো কিছু বলেন যেন টেবিল ল্যাম্পটা মন খারাপ না করে।”
“মন খারাপ না করে?”
“জে নানি।”
বুড়ি নানি একটু সময় চিন্তা করে বলল, “আমার প্রিয় টেবিল ল্যাম্প। কত রাত তোমাকে জ্বালিয়ে বই পড়েছি এখন আর আগের মত বই পড়তে পারি না। তোমাকে তাই বিদায়।”
ঝুমু সাহায্য করল, বলল, “বলেন, মনে কষ্ট নিও না সোনামনি টেবিল ল্যাম্প।”
বুড়ি নানি বললেন, “মনে কষ্ট নিও না সোনামনি টেবিল ল্যাম্প।” ঝুমু খালা তখন টেবিল ল্যাম্পটাও চাঁদরের ওপর রাখল।
প্রথম প্রথম বুড়ি নানির জিনিসপত্রগুলোকে বিদায় দেওয়ার জন্যে কথা বলতে একটু অস্বস্তি হচ্ছিল, মনে হয় একটু ইতস্তত করছিলেন, একটু লজ্জা পাচ্ছিলেন। কিন্তু আস্তে আস্তে তার লজ্জা কেটে গেল, তখন নিজেই উৎসাহ নিয়ে নানারকম কথা বলে জিনিসগুলোকে বিদায় দিতে লাগলেন। একটা পুতুলকে বললেন, “ওরে আমার আদরের পুতুল! এই ভিড়ের মাঝে থেকে থেকে তুমি নিশ্চয়ই ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে গেছ? যাও এখন মনের সুখে ঘুরে বেড়াও।” একটা শ্যাম্পুর শিশিকে বললেন, “ভাই শ্যাম্পু, তোমাকে মাথায় দিইনি দেখে তুমি নিশ্চয় আমার ওপরে রাগ করেছ। রাগ করো না ভাই, অন্য কারো কালো চুলে তুমি আনন্দ করো। বুড়ো মানুষের চুলে কোনো আনন্দ নাই।”