ঝুমু খালা বিশাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তুমি আর আমাকে কী সাহায্য করবা?” তারপর গলা নামিয়ে বলল, “এর থেকে খেড়ের গাদার মাঝে সুই খোজা সোজা।”
টুনি চোখের কোনা দিয়ে লক্ষ করছিল বুড়ো মহিলা তার চিঠিটা কী করেন। এটাকে সাবধানে রাখার জন্যে নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও রাখবেন। কোথায় রাখেন সেটাই টুনি দেখতে চায়।
টুনি দেখল বুড়ো মহিলা তার জিনিসপত্রের ওপর দিয়ে সাবধানে চড়ই পাখির মতো পা ফেলে শেলফের কাছে গেলেন। তারপর শেলফের ওপর থেকে একটা বই নিয়ে সেই বইয়ের ভেতর চিঠিটা রেখে বইটা আবার শেলফের ওপর রেখে দিলেন। তার মানে এটা হচ্ছে এই ভদ্রমহিলার দরকারি কাগজপত্র রাখার সিস্টেম। তাঁর হারিয়ে যাওয়া লাল খামটি এই বইগুলোর ভেতর খুঁজে দেখতে হবে। দেখা যাচ্ছে বইগুলোর ভেতর নানা ধরনের কাগজপত্র গুঁজে রাখা আছে।
টুনি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল, ভদ্রমহিলা যখন একটু সরে গিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলেন তখন সে তাড়াতাড়ি শেলফের কাছে গিয়ে বইগুলোর ভেতর খুঁজতে থাকে। অনেকগুলো বইয়ের ভেতরেই নানা ধরনের কাগজ, খাম, চিঠি, ফটো আছে, তবে লাল খাম একটিও নেই। টুনি হতাশ হয়ে চলে আসার আগে আবার বইগুলোর ভেতর তাকায়। তার হঠাৎ মনে পড়ল সেদিন সে শিখেছে মানুষ প্রায় সময়েই ভুল জিনিস দেখে। ভুল জিনিস মনে রাখে। ভদ্রমহিলা সারাক্ষণই লাল খামের কথা বলেছেন, এমন কী হতে পারে খামটা লাল না, সেটা সাদা কিংবা হলুদ? মনে রেখেছেন লাল হিসেবে?
টুনি যখন দ্বিতীয়বার বইগুলোর ভেতর দেখে তখন হঠাৎ একটা বইয়ের ভেতর হলুদ একটা খাম পেল।
ভদ্রমহিলার ঠিকানায় লেখা চিঠি। খামের কোনায় লেখা “এডভোকেট রাহাত সমাদ্দার” তার নিচে লেখা “সিনহা এন্ড সমাদ্দার” ঠিক যেরকম ভদ্রমহিলার ছেলে বলেছিল। খামটা মোটেও লাল নয়। খামটা হলুদ। এই বাসায় সারাক্ষণ সবাই লাল খাম খুঁজেছে সেজন্যে কেউ কখনো পায়নি।
টুনি খামটা নিয়ে তার ভেতরের চিঠিটা বের করে পড়ার চেষ্টা করল। কটমটে আইনি ভাষা পড়ে কিছু বোঝা যায় না। শুধু অনুমান করতে পারল এখানে বেশ কিছু তথ্য, দলিলের কপি এইসব আছে। খুবই জরুরি কিছু কাগজপত্র। এগুলো নিয়ে কিছু একটা করতে হবে। এই চিঠিটাই এতদিন থেকে সবাই মিলে খুঁজছে। লাল খাম হিসেবে খুঁজেছে বলে কেউ খুঁজে পায় নাই।
টুনি খামটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল তারপর যেখানে ছিল সেখানেই রেখে দিয়ে ঝুমু খালার কাছে ফিরে এলো। ঝুমু খালা টুনিকে দেখে আবার একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলতে যাচ্ছিল, টুনি তার আগেই ফিস ফিস করে বলল, “ঝুমু খালা, পেয়ে গেছি।”
ঝুমু খালা অবাক হয়ে বলল, “কী পায়া গেছ?”
“ঐ চিঠিটা।”
ঝুমু খালার কিছুক্ষণ লাগল বুঝতে, টুনি কোন চিঠির কথা বলছে। যখন বুঝতে পারল তখন একটা চিৎকার দিতে গিয়ে শেষ মুহূর্তে থেমে গেল। তারপর টুনির মতোই ফিস ফিস করে বলল, “কোন খানে পাইছ?”
টুনি হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল, “ঐ শেলফের ওপর বইয়ের ভেতর।”
“তুমি বুঝলা কেমন করে যে ঐ শেলফের বইয়ের ভেতরে থাকব?”
“আন্দাজ করেছি। উনি সব দরকারি কাগজ ঐখানে রাখেন দেখলাম।”
ঝুমু খালা চোখ কপালে তুলে বলল, “এতদিন ধইরা কেউ তাইলে খুঁইজ্জা পাইল না কেন?”
“সবাই লাল খাম খুঁজেছে। খামটা আসলে লাল না। হলুদ।”
“হলুদ?’
টুনি মাথা নাড়ল। ঝুমু খালা সন্দেহের চোখে বলল, “আসল চিঠিই পাইছ নাকি ভুলভাল?”
“আসল চিঠি, খুলে দেখেছি।”
ঝুমু খালা তখন টুনির মাথায় ঠোকা দিয়ে বলল, “তোমার মগজের মাঝে খালি ব্রেন।”
“ঝুমু খালা, মগজের ইংরেজি হচ্ছে ব্রেন।”
“একই কথা।” ঝুমু খালা সবগুলো দাঁত বের করে একটা হাসি দিয়ে বলল, “তাহলে বুড়ি নানিরে ডাকি?”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “আগেই না। চিঠিটা তো সহজ ছিল, এই বাসার জিনিসপত্র খালি করার একটা বুদ্ধি বের করা যাবে? তাহলে এই নানির একটা উপকার হয়।”
ঝুমু খালা ঠোঁট সুচাল করে ওপরের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করল, “তারপর মুখ হাসি হাসি করে বলল, “একটা জিনিস চেষ্টা করে দেখতে পারি।”
“কী জিনিস?”
“আমার কিছু একটিং করতে হইতে পারে।”
“একটিং? কী একটিং?”
“আমি তো একটা একটিংই পারি। সেইটা হলো ইন্দুর মারার একটিং।”
“ইঁদুর মারার একটিং?”
“হা। এই দেখো–” বলে টুনি কিছু বোঝার আগেই ঝুমু খালা একটা গগণবিদারী চিৎকার দিল। সেই চিৎকার শুনে মনে হলো কেউ বুঝি ঝুমু খালাকে খুন করে ফেলছে।
চিৎকার শুনে প্রথমে বাসার কাজে সাহায্য করার মহিলা ছুটে এলো। তার পিছু পিছু বুড়ি নানি ছুটে এলেন, এবারে আর চড়ুই পাখির মতো পা ফেলে নয় শালিখ পাখির মতো লাফিয়ে লাফিয়ে। ঝুমু খালার মতোই চিৎকার করতে লাগলেন, “কী হয়েছে? কী হয়েছে?”
ঝুমু খালা কোনো উত্তর না দিয়ে প্রথমে এদিক সেদিক কয়েকটা লাফ দিল, তারপর নিচু হয়ে একটা পিতলের ফুলদানি তুলে সেটা দিয়ে দমাদম করে অদৃশ্য একটা ইঁদুরকে পিটাতে লাগল। ইঁদুরের পিছু পিছু ঘরের ভেতর ছোটাচ্চুটি করতে করতে ঝুমু খালা চিৎকার করতে লাগল, “মার! ইন্দুরের বাচ্চারে মার।”
বয়স্ক বুড়ি নানিও আতংকে চিৎকার করতে করতে বিছানার উপর লাফিয়ে উঠে সেখানেই লাফাতে লাগলেন। ঝুমু খালা পিতলের ফুলদানি দিয়ে অদৃশ্য ইঁদুরকে মারার চেষ্টা করতে করতে একসময় হাল ছেড়ে দিয়ে হাপাতে লাগল। বুড়ি নানি বিছানার ওপর থেকে জিজ্ঞেস করলেন, “কি ছিল? ইঁদুর?”