ছোটাচ্চু কী আর করবে, টিকটিকি হয়ে হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল। মানুষটা ঝুমু খালাকে দেখিয়ে বলল, “ইনি মিস ঝুমু। জিনিস খুঁজে বের করার এক্সপার্ট আর তার সাথে ছোট মেয়েটা টুনি। এসেছে সাথে থাকার জন্য!”
বুড়ো মহিলা চোখ বড় বড় করে তাদের দিকে তাকালেন, তারপর বললেন, “খুঁজে বের করা একটুও কঠিন হবে না। লাল রংয়ের খাম, ওপরে হাতে লেখা ঠিকানা। একটু ঘাঁটাঘাঁটি করলেই পেয়ে যাবে।”
ঝুমু খালা আবার হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে মাথা নাড়ল, তারপর বলল, “এই বাসার মইধ্যে এক খুচরা মাল যে একটা একটা করে জিনিস সরায়া খুঁজতে কম পক্ষে দশ বছর লাগব! বেশিও লাগতে পারে।”
ছোটাচ্চু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “কী বলছ ঝুমু। তুমি কী একটা একটা জিনিস সরিয়ে খুঁজবে? তুমি খুঁজবে মাথা খাঁটিয়ে। তোমাকে এনেছি কী জন্যে?”
ঝুমু খালাকে মাথা খাটানো নিয়ে খুব উৎসাহী দেখা গেল না।
কিছুক্ষণ ভদ্রতার কথাবার্তা বলে ছোটাচ্চু চলে গেল। অবশ্যি চলে গেল না বলে পালিয়ে গেল বলাই ঠিক হবে। ভদ্রমহিলার ছেলেও সরে পড়ল, ঘরের মাঝে রইল শুধু ঝুমু খালা আর টুনি।
ঝুমু খালা তার শাড়িটা কোমরে প্যাচিয়ে বলল, “নানি, এইবারে বলেন দেখি আপনি আপনার চিঠিটা কুন ঘরে কুন জায়গায় রাখছিলেন।”
বুড়ো ভদ্রমহিলাকে এক সেকেন্ডের জন্যে একটু বিভ্রান্ত দেখাল কিন্তু তারপরেই নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললেন, “আস, আমার সাথে, তোমাকে দেখাই।”
ঝুমু খালা আর টুনি ভদ্রমহিলার পিছু পিছু ভেতরে গেল। একটা বড় ঘরের ভেতর দিয়ে তারা ভেতরে ভদ্রমহিলার বেডরুমে পৌঁছালো। এখানে একটা বিছানা আছে সে জন্যে বোঝা যাচ্ছে এটা বেডরুম তা না হলে ঘরটা এমনভাবে জিনিসপত্র দিয়ে বোঝাই যে এটা যে একটা বেডরুম সেটা বোঝার কোনো উপায়ই ছিল না। ঘরের এক পাশে একটা ড্রেসিং টেবিল, একটা বড় আলমারি, শেলফ, কাপড় রাখার একটা আলনা এবং প্রত্যেকটা জিনিসের ওপর নানারকম জিনিসপত্র। শেলফের ওপরে এবং নিচে বই। আলমিরার ওপরে কম্বল এবং বিছানার চাঁদর। আলনার ওপর নানা ধরনের কাপড়। ঘরে ছড়ানো-ছিটানো নানা সাইজের নানা আকারের পুতুল। এ ছাড়াও আছে তেল-শ্যাম্পু ক্রিম এবং কসমেটিকস। শুধু এই ঘরে যে জিনিস আছে সেই জিনিস দিয়ে নিউ মার্কেটে তিনটা দোকান বোঝাই করা সম্ভব।
সাবধানে পা ফেলে বুড়ো মহিলা তার বিছানার কাছে গিয়ে বললেন “এই বিছানায় বসে আমি চিঠিটা পড়েছি। উঁকিলের চিঠি। পড়ে কিছু বুঝি নাই। কিন্তু মনে হয় চিঠিটা খুব দরকারি। তাই বিছানা থেকে ওঠে চিঠিটা–” ভদ্রমহিলা থেমে গিয়ে তার ধবধবে সাদা চুলে ঢাকা মাথাটা চুলকালেন, তারপর একটু অপ্রস্তুতের মত হাসলেন। হেসে বললেন, “তারপরে মনে হয় এই ঘরে কোনো এক জায়গায় চিঠিটা সাবধানে রাখলাম।”
“কোন জায়গায়? চিন্তা করেন? চোখ বন্ধ করে চিন্তা করেন।”
বুড়ো ভদ্রমহিলা চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চিন্তা করে হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল, “নাহ। মনে পড়ছে না।” ড্রেসিং টেবিলের ওপর হতে পারে। শেলফের উপর হতে পারে। আবার আলমারির ভেতর হতে পারে। কথা শেষ করে ভদ্রমহিলা আবার খিক খিক করে একটু হাসলেন। টুনি লক্ষ করল তাঁর হাসিটা খুবই মজার।
ঝুমু খালা কী আর করবে, চিঠি খোজার জন্যে ড্রেসিং টেবিলের কাছে গিয়ে তার ওপরে রাখা জিনিসপত্র খানিকক্ষণ নাড়াচাড়া করল। এদিক-সেদিক দেখল, একটা ড্রয়ার খুলে ভেতরে তাকাল। দুই-একটা জিনিস বের করে আবার ঢুকিয়ে রাখল। বোঝাই যাচ্ছে এই বাসায় সত্যি সত্যি কোনো একটা জিনিস খুঁজে বের করা অসম্ভব।
টুনি তখন বুড়ো মহিলার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল। বুড়ো মহিলার তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাম কী? কোন ক্লাসে পড়।”
টুনি নাম বলল, ক্লাস বলল। বুড়ো মহিলা তখন মাথা নেড়ে ষড়যন্ত্রীদের মতো বললেন, “তোমাদের দেখে আমার মায়া হয়। চাও আর না চাও তোমাদের লেখাপড়া করতে হয়। আমাদের সময় লেখাপড়া না করলে নাই! বাবা-মা ধরে বিয়ে দিয়ে দিত। আমার যখন বিয়ে দিয়েছিল তখন আমার বয়স চৌদ্দ।”
“আপনার হাজব্যান্ড কোথায়?”
“মরে গেছে। আজ প্রায় বিশ বছর–”
“এতদিন?”
“হ্যাঁ। ভদ্রমহিলা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “বেচারা মরে যাবার পর একা হয়ে গেছি। সময় কাটে না তাই দোকানে দোকানে ঘুরে বেড়াই। জিনিসপত্র কিনি। সময়টা কাটে।”
“আপনি এই বাসায় কতদিন থেকে আছেন?”
“পঞ্চাশ বছর তো হবেই। বেশিও হতে পারে।”
টুনি চারিদিকে তাকাল। অর্ধশতাব্দীর জিনিসপত্র চারিদিকে ছড়ানো। তখন হঠাৎ মনে পড়েছে সেরকম ভঙ্গি করে বলল, “নানি। আমার এই চিঠিটা আমি হাতে করে নিয়ে এসেছিলাম।” টুনি তার হাতে ধরে রাখা খামটা–যেটা বাসা থেকে এনেছে সেটা দেখাল। তারপর বলল, “এই খামটা খুবই দরকারি। আপনার হাতে একটু দিই? কোনো এক জায়গায় সাবধানে একটু রাখবেন? যাওয়ার সময় নিয়ে যাব। আমি ঝুমু খালাকে একটু সাহায্য করি?”
বুড়ো মহিলা বললেন, “আমি? আমি রাখব?”
“হ্যাঁ। প্লিজ।” বলে বুড়ো মহিলা কিছু বলার আগে তার হাতে খামটা ধরিয়ে দিয়ে ঘরে ছড়ানো-ছিটানো অসংখ্য জিনিসপত্রের ভেতরে সাবধানে পা ফেলে ঝুমু খালার কাছে হাজির হয়ে বলল, “ঝুমু খালা। আমি তোমাকে সাহায্য করি?”