মানুষটা চমকে উঠে বলল, “কী? কী বললেন?”
“বলছি অবস্থা কেরোসিন।”
“মানে? কেরোসিন মানে?”
টুনি তাড়াতাড়ি বলল, “ঝুমু খালা বলতে চাইছে অবস্থাটা একটু জটিল।”
মানুষটা বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ জটিল তো বটেই। যে চিঠিটা এতদিন থেকে খুঁজছি কিন্তু খুঁজে পাচ্ছি না তার এক নম্বর কারণ বাসা বোঝাই জিনিসপত্র। এত জিনিসপত্র থাকলে জিনিস কী খুঁজে পাওয়া যায়?”
ঝুমু খালা আবার লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “অবস্থা আসলেই কেরোসিন।”
কথাটার মানে কী এইবারে আর মানুষটাকে বোঝাতে হলো না। মানুষটাও লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “তবে এই চিঠিটা খুঁজে পাওয়া সহজ হওয়ার কথা। চিঠিটা একটা বড় খামে। খামটা লাল রংয়ের। ওপরে হাতে লেখা ঠিকানা।”
ছোটাচ্চু বলল, “চিঠিটা কে পাঠিয়েছে?”
“এডভোকেট রাহাত সমাদ্দার। তাদের ফার্ম থেকে। ফার্মের নাম সিনহা এন্ড সমাদ্দার।”
টুনি নামটা কয়েকবার আওড়ে নিয়ে মনে রাখার চেষ্টা করল।
.
ট্রাফিক জ্যাম ঠেলে শেষ পর্যন্ত তারা একটা বাসায় পৌঁছাল। বড় কম্পাউন্ড নিয়ে একটা বাসা, বড় লোকদের বাসা যেরকম হয়। দারোয়ান গেট খুলে দিল। মানুষটা বাসার সামনে গাড়িটা থামাল। নামার আগে ঝুমু খালা হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, “আংকেল আপনারে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
মানুষটা বলল, “অবশ্যই। অবশ্যই।”
“আপনারা আমাগো কী খালি চিঠিটা খোঁজার জন্য আনছেন নাকি বাসাটা খালি করে দেবার জন্যে আনছেন। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে বাসা খালি না করে চিঠিটা বের করা যাব না।”
মানুষটা ভালো মানুষের মতো হেসে ফেলল। বলল, “না, বাসা খালি করে দেবার জন্য আনিনি, কারণ মনে হয় সেটা সম্ভব না। তবে কেউ যদি আসলেই মাকে বুঝিয়ে বাসাটা খালি করে দিতে পারত তাকে আমরা একটা গোল্ড মেডেল দিতাম। স্যালুট করতাম।”
ঝুমু খালা বুঝে ফেলার মতো ভঙ্গি করে মাথা নাড়ল, দাঁতের ফাঁক দিয়ে শব্দ করে বলল, “কেরোসিনের ওপরে ডিজেল!”
বাসার দরজায় শব্দ করতেই খুট করে দরজাটা খুলে গেল। একজন কাজের মহিলা দরজাটা খুলে দিয়েছে। মানুষটা তাকে জিজ্ঞেস করল, “মা কী করে?”
“টেলিভিশন দেখে।”
“যাও। মাকে ডাকো। বল গেস্ট এসেছেন।”
মানুষটা তখন ছোটাচ্চু, টুনি আর ঝুমু খালাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল। ভেতরে ঢুকেই টুনি একটা ধাক্কা খেলো। এটা বসার ঘর কিন্তু এটাকে মনে হচ্ছে একটা গুদামঘর। গতবার ঈদের আগে একবার তাকে নিয়ে তার আম্মু কাঁচা বাজারে গিয়েছিল। সেই কাঁচাবাজারে একটা দোকান বোঝাই ছিল জিনিসপত্রে, দোকানের মানুষটা কোনোভাবে একটা কোনায় বসেছিল মনে হচ্ছিল একটু নাড়াচাড়া করলেই তার ওপর চাল-ডাল মসলা-ঘি, সেমাই সব হুড়মুড় করে পড়বে। এখানেও তাই–চারিদিকে শুধু জিনিস আর জিনিস, মনে হলো এক্ষুনি বুঝি সবকিছু তাদের ওপর পড়বে।
দেওয়ালে নানা ধরনের পেইন্টিং। যতগুলো আঁটে তার থেকে বেশি, উপরে নিচে-ডানে-বামে শুধু পেইন্টিং আর ফ্রেম। কিছু ছবি ভালো কিছু কুৎসিত। কিছু দামি কিছু সস্তা। বসার ঘরে অনেকগুলো শো-কেস, প্রত্যেকটা শো-কেস বোঝাই নানা ধরনের পুতুল কিংবা শো-পিস দিয়ে, ভেতরে ঢুকিয়ে ঠেসে কাঁচের দরজা বন্ধ করা হয়েছে। দরজাটা খুললেই শো-পিসগুলো নিচে পড়বে। শো কেসের ওপরেও নানা ধরনের জিনিসপত্র একেবারে ছাদ পর্যন্ত পৌঁছেছে। ঘরের ভেতর বড় শেলফ। শেলফ বোঝাই নানা রকম বই। শেলফে বই আঁটে না বলে অনেক বই মেঝেতে।
বসার ঘরে সাধারণত একটা সোফা সেট থাকে কিন্তু এই বসার ঘরে মনে হয় তিন থেকে চার সেট সোফা। কিছু দামি, কিছু অতি কুৎসিত! সোফার ওপর নানারকম জিনিস, মানুষ কেমন করে এখানে বসবে সেটা একটা রহস্য। সোফার সামনে টেবিল, টেবিলের ওপর রাজ্যের জিনিস, টেবিলের নিচে জিনিসপত্র আরো অনেক বেশি। এখানে-সেখানে অসংখ্য ফুলদানি এবং সেই ফুলদানিতে ক্যাটক্যাটে রংয়ের প্লাস্টিকের ফুল। চারিদিকে নানা ধরনের বাক্স, বাক্সের ভেতর কী আছে কে জানে, অনেক বাক্স মনে হয় জীবনেও খোলা হয়নি। সবকিছু মিলিয়ে ঘরের ভেতর কেমন জানি গুমোট একটা গন্ধ।
টুনি আরো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই মানুষটির বয়স্কা মা এসে ঢুকলেন। জিনিসপত্রের ফাঁকে ফাঁকে চড়ইপাখির মতো পা ফেলে থুড়থুড়ে বুড়ো মহিলাটি কাছে এসে বললেন, “ও খোকা এসেছিস? বউমা ভালো আছে? নিয়ে আসলি না কেন? বুবাই কী করে? পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে? বিন্তী না ইন্ডিয়া যাবে? গিয়েছিল? কেমন লেগেছে?”
অনেকগুলো প্রশ্ন করে তার উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করেই বললেন, “কয়দিন থেকে মাথাটা কেমন জানি উড়া উড়া লাগছে। এক বোতল জবা কুসুম তেল কিনে এনেছি এখন বোতলটা আর খুঁজে পাই না। কোথায় যে রেখেছি।”
বুড়ো মহিলার ছেলে, যার নাম খোকা কিংবা ভদ্রমহিলা যাকে খোকা বলে ডাকেন, মাথা নেড়ে বলল, “মা তুমি এই বাসায় কিছু খুঁজে পাবে না। কেমন করে পাবে; দেখেছ কত জিনিস?”
ঝুমু খালা মাথা নেড়ে বলল, “খুচরা মাল।”
মানুষটা এবারে ঝুমু খালার দিকে তাকাল, তারপর তার মাকে বলল, “মা তোমাদের পরিচয় করিয়ে দিই। এই যে এরা এসেছেন তোমার চিঠিটা খুঁজে বের করতে।” ছোটাচ্চুকে দেখিয়ে বলল, “ইনি শাহরিয়ার সাহেব, অনেক বড় ডিটেকটিভ!”
বুড়ো মহিলা খিক খিক করে হেসে বললেন, “আসল টিকটিকি! হি হি হি।”