ছোটাচ্চু বলল, “কেন হবে না?”
“আমি অন্যের বাড়িতে গিয়া তার মাল সামানে হাত দিমু? কক্ষনো না। এই বাসা আমার নিজের বাসা; আমি এর ড্রয়ার খুলি, হের আলমারি খুলি কেউ আমারে কিছু কয় না। অন্য বাড়িতে কোনো জিনিসে হাত দিলেই বুড়ি হ্যাঁৎ করে উঠব।”
ছোটাচ্চু বলল, “না, না, হ্যাঁৎ করে উঠবে কেন? আমাকে টাকা-পয়সা দিচ্ছে চিঠিটা খোঁজার জন্য। পুরো বাসা ওলট পালট করে ফেললেও কিছু বলবে না।”
ঝুমু খালা গম্ভীর গলায় বলল, “জে না। মানুষজনের মাল-সামানা খুবই পেরাইভেট। অন্যের পেরাইভেট জায়গায় হাত দিতে হয় না।”
ছোটাচ্চুকে এবারে খানিকটা অসহায় দেখাল, মাথা চুলকে বলল, “ইয়ে ঝুমু–আমি তোমার ওপর ভরসা করে রাজি হয়েছি। এখন তুমি যদি বেঁকে বস বিপদে পড়ে যাব। প্লিজ রাজি হয়ে যাও।”
শান্ত বলল, “ঝুমু খালা, তোমার ফি’টা ডাবল করে দাও। এই সুযোগ। আমি তোমার সেক্রেটারি হয়ে যাব।”
ঝুমু খালা বলল, “জে না। কাজটা ঠিক হবে না।”
ছোটাচ্চু বলল, “তুমি একবার গিয়ে শুধু দেখ। আমাকে বলো কীভাবে কী করতে হবে। তুমি না চাইলে তোমার নিজের করতে হবে না।”
টুনি বলল, “ঝুমু খালা রাজি হয়ে যাও। দরকার হলে আমি থাকব তোমার সাথে।”
ঝুমু খালা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, “ঠিক আছে আমি একবার গিয়া বাসাটা দেখতে পারি, তার বেশি কিছু না।”
সবাই তখন আনন্দের একটা শব্দ করল, ছোটাচ্চুর গলা উঠল সবার ওপরে।
.
দুই দিন পর বিকেল বেলা ছোটাচ্চু এসে ঝুমু খালাকে ডেকে বলল, “ঝুমু, তুমি রেডি হয়ে নাও।”
ঝুমু খালা ভুরু কুঁচকে বলল, “কি জন্য?”
“মনে নাই একটা চিঠি খুঁজে দিতে হবে?”
ঝুমু খালাকে কেমন যেন একটু বিপর্যস্ত দেখাল। আমতা আমতা করে বলল, “আমি একলা?”
“আর কে যাবে তোমার সাথে? “পোলাপান কাউরে নেই সাথে?”
“কাকে নেবে?”
“দেখি কারে পাই।”
ঝুমু খালা টুনিকে পেয়ে গেল। অন্য বাচ্চাদের থেকে টুনিকেই ঝুমু খালার বেশি পছন্দ। মেয়েটার মাথার মাঝে মনে হয় বুদ্ধি গিজ গিজ করছে। কাজকর্ম কথাবার্তাতেও ধীর-স্থির।
টুনি খুব আনন্দের সাথে যেতে রাজি হলো। যাবার আগে সে একটা সিল করা খাম নিল, খামের ওপর তার নিজের নাম ঠিকানা লেখা। খামটা কেন নিল, খামের ভেতর কী আছে কেউ জানে না।
খানিকক্ষণ পর ঝুমু খালা আর টুনি ছোটাচ্চুর সাথে নিচে নেমে দেখে বাসার সামনে একটা ঢাউস গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির সামনে একজন মাঝবয়সী মানুষ, মানুষটার মাথার সামনে চুল হালকা হয়ে আসছে, সেই জন্যে মনে হয় কপালটা অনেক বড়। ঝুমু খালা বলেছে বড় লোকদের কপাল এরকম হয়। মানুষটা একটা সাদা রংয়ের হাফ হাতা শার্ট পরে আছে। ছোটাচ্চুকে দেখে বলল, “থ্যাংক ইউ শাহরিয়ার সাহেব, আপনি রাজি হওয়ার জন্য। এই চিঠিটা খুবই দরকারী চিঠি, মা কীভাবে যে হারিয়ে ফেলল। খুঁজে পাওয়া না গেলে অনেক বড় ঝামেলায় পড়ব। প্রোপার্টি নিয়ে ঝামেলা।”
ছোটাচ্চু কিছু না বলে হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে রইল। মানুষটা তখন একটু জিজ্ঞাসার ভঙ্গি করে ঝুমু খালা আর টুনির দিকে তাকাল, ভদ্রভাবে জানতে চাইছে এরা কারা। ছোটাচ্চু বলল, “আপনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই। এই হচ্ছে ঝুমু, হারিয়ে যাওয়া জিনিস খুঁজে বের করার এক্সপার্ট। তাকেও সাথে নিচ্ছি।” তারপর টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “আর এ হচ্ছে টুনি। ঝুমু যেন একা একা বোরিং ফিল না করে সেজন্যে যাচ্ছে। আমার ভাতিঝি।”
মানুষটা বলল, “বেশ বেশ। তাহলে গাড়িতে উঠে যাই।”
গাড়ির ড্রাইভার নেই মানুষটা নিজেই গাড়ি চালাবে। ছোটাচ্চু তার সাথে সামনে বসল। টুনি আর ঝুমু বসল পেছনে।
গাড়িটা যখন বড় রাস্তায় উঠে একটা ট্রাফিক জ্যামে আটকে গেল তখন মানুষটা কেমন যেন একটু অপরাধীর মতো গলায় বলল, “আমার মায়ের বাসায় নেওয়ার আগে আপনাদের মনে হয় একটু সাবধান করে নেয়া ভালো।”
ছোটাচ্চু একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “সাবধান? কী নিয়ে সাবধান।”
“আমার মাকে নিয়ে।”
“আপনার মাকে নিয়ে? কী হয়েছে আপনার মায়ের?”
“মানে আমার মা একটু একসেনট্রিক টাইপ, মানে বাতিকগ্রস্ত বলতে পারেন। যত বয়স হচ্ছে সেটা আরেকটু বেড়ে যাচ্ছে।”
ছোটাচ্চু একটু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী করেন আপনার মা?”
“এমনিতে বেশ হাসি-খুশি। কিন্তু জিনিসপত্র নিয়ে একটু বাড়াবাড়ি আছে।”
“জিনিসপত্র নিয়ে বাড়াবাড়ি?”
“হ্যাঁ। বাইরে গেলেই কিছু একটা কিনে ফেলেন–টাকা-পয়সার তো অভাব নেই, যেটা ইচ্ছা সেটা কিনতে পারেন। জিনিসপত্র কিনে কিনে বাসাটা বোঝাই করে রেখেছেন, কিছু ফেলতেও পারেন না, তাই আস্তে আস্তে বাসাটা দরকারি বেদরকারি জিনিসে বোঝাই হয়ে আছে। এখন এমন অবস্থা–” মানুষটা কথা শেষ না করে থেমে গেল।
ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “কি অবস্থা?”
“বাসার ভেতরে বলতে গেলে হাঁটার জায়গা নেই।”
“আপনারা আপনার মা’কে কিছু বলেন না?”
“কতবার বলেছি!” মানুষটা দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ করে বলল, “সবাই মিলে হাজার বার বলেছি, যে জিনিসের দরকার নেই সেগুলো ফেলে দিই কিংবা কোথাও দান করে দিই। মা রাজিও হন কিন্তু সত্যি সত্যি বাসা খালি করার সময় হলে তখন আর উৎসাহ দেখান না। জিনিসপত্র বাড়তেই থাকে।”
পেছন থেকে ঝুমু খালা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল “কেরোসিন।”