নিজেদের রুমে গিয়ে সবাই কাপড়-জামা বদলে তখন তখনই সমুদ্রে যাবার জন্যে বের হয়ে এলো। ছোটাচ্চু তখন বলল লাঞ্চের সময় হয়ে গিয়েছে, তাই সমুদ্রে যাওয়ার আগে সবাইকে খেয়ে নিতে হবে। খাওয়ার কথা শুনে এক সাথে সবার খিদে পেয়ে যায়। হোটেলের দোতলায় রেস্টুরেন্ট সবাই মিলে যখন যাচ্ছে তখন পাশের একটা রুম থেকে একজন মানুষ ছোট একটা মেয়েকে নিয়ে বের হলো। মেয়েটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, কেন কাঁদছে কে জানে? মেয়েটা মুনিয়ার বয়সী, মেয়েটাকে কাঁদতে দেখে মুনিয়ারও আম্মুর কথা মনে পড়ে গেল আর তার চোখও ছল ছল করে উঠল।
রেস্টুরেন্টে কয়েকটা টেবিল এক সাথে লাগিয়ে তাদের সবার বসার জায়গা করা হয়েছে। কে কার পাশে বসবে সেটা নিয়েও একটু ঝগড়াঝাটি হলো, তখন ছোটাচ্চুর একটা রাম ধমক খেয়ে সবাই ঝগড়াঝাটি মিটিয়ে খেতে বসে গেল।
কাজেম আলী চাচা তখন টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে প্রায় বক্তৃতা দেওয়ার মতো ভঙ্গি করে বলল, “সবাই আমার দিকে তাকাও, আমি কয়েকটা জিনিস তোমাদের সবাইকে জানিয়ে রাখি।”
তারা এই প্রথম কাজেম আলী চাচার গলার স্বর শুনতে পেয়েছে। এই মানুষটা কথা বলতে পারে কী না সেটা নিয়েই তাদের সন্দেহ হতে শুরু করেছিল। সবাই কৌতূহল নিয়ে কাজেম আলী চাচার দিকে তাকাল তখন কাজেম আলী চাচা বলল, “সমুদ্রে যাওয়ার কিছু নিয়ম-কানুন আছে সেগুলো না জেনে কেউ সমুদ্রে নামতে পারবে না। একটা নিয়ম হচ্ছে ভাটার সময় কখনোই সমুদ্রে নামা যাবে না। সমুদ্রে নামতে হবে জোয়ারের সময়।”
বাচ্চারা তখন সবাই এক সাথে প্রশ্ন করতে শুরু করল, প্রশ্নগুলো হলো এরকম:
“কেন ভাটার সময় সমুদ্রে নামা যাবে না?” “ভাটা কী?”
“কতক্ষণ ভাটা হয় কতক্ষণ জোয়ার হয়?”
“আমরা কেমন করে বুঝব কখন ভাটা কখন জোয়ার?”
“ভাটার সময় আমি যদি সমুদ্রে নামি তাহলে কী হবে?”
কাজেম আলী চাচা একটা একটা করে সবার প্রশ্নের উত্তর দিল:
“ভাটার সময় সমুদ্র সবকিছু নিজের দিকে টেনে নেয়, তাই ভাটার সময় সমুদ্রে নামলে সমুদ্র কাউকে টেনে নিয়ে যেতে পারে।”
“সমুদ্রের পানি যখন নেমে যেতে থাকে সেটা হচ্ছে ভাটা। সমুদ্রের পানি যখন বাড়তে থাকে সেটা জোয়ার।”
“ছয় ঘণ্টা ভাটা এবং ছয় ঘণ্টা জোয়ার থাকে।”
“ভাটার সময় হোটেলে সামনে একটা লাল ফ্ল্যাগ টানানো থাকে, এই ফ্ল্যাগ দেখেই বোঝা যাবে এখন ভাটা না জোয়ার।”
“আমার কথা না শুনে কেউ যদি ভাটার সময় সমুদ্রে নেমে যায় তাহলে আমি তাকে টেনে শুকনায় নিয়ে আসব। তারপর জোয়ার না আসা পর্যন্ত তাকে শুকনা বালুতে ঠেসে চেপে ধরে রাখব। স্যার আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন সবাইকে দেখে-শুনে রাখতে।
কথা শেষ করে কাজেম আলী চাচা জিজ্ঞাসা করল, “আর কোনো প্রশ্ন?
অনেকেরই প্রশ্ন ছিল কিন্তু কাজেম আলী চাচার চেহারা দেখে কেউ আর প্রশ্ন করার সাহস পেল না। কাজেম আলী চাচা থমথমে গলায় বলল, “টেবিলে মেনু রাখা আছে। মেনু দেখে সবাই ঠিক করো কে কী খাবে?”
শান্ত ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “যেটা ইচ্ছা তাই অর্ডার করতে পারব? “হ্যাঁ। যেটা ইচ্ছা তাই অর্ডার করতে পারবে।”
সবাই তখন খাবার অর্ডার করতে শুরু করল। বাসায় যে খাবার তারা জন্মেও মুখে দিতে চায় না এই হোটেলে এসে হঠাৎ করে সেই খাবারগুলোও তাদের কাছে সুস্বাদু মনে হতে থাকে। মনে হয় সমুদ্রের বাতাসের এই গুণ।
খাওয়া শেষ করে তারা যখন বের হয়ে যাচ্ছে তখন তারা আবার তাদের পাশের রুমের বাবা আর মেয়েটাকে দেখতে পেল। মেয়েটা তখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, বাবার মুখটা পাথরের মতো শক্ত।
বাচ্চা মেয়েটাকে দেখে মুনিয়া দাঁড়িয়ে গেল। তাকে প্রায় জড়িয়ে ধরে বলল, “আপু, তুমি কাঁদছ কেন?”
মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমি আম্মুর কাছে যাব।”
মেয়েটার কথা শুনে তার বাবা কেমন যেন থতমত খেয়ে গেল। বাবা মেয়েটাকে চুপ করানোর চেষ্টা করতে থাকে, কিন্তু মেয়েটা চুপ করে না, বলতে থাকে, “আম্মুর কাছে যাব। আম্মুর কাছে যাব।”
মুনিয়া জানতে চাইল, “তোমার আম্মু কোনখানে?”
“বাসায়।”
এবারে টুনি জিজ্ঞেস করল, “তোমার বাসা কোথায়?”
মেয়েটা কিছু বলার আগেই বাবা মেয়েটাকে কোলে তুলে নেয়, মাথাটা জোর করে নিজের ঘাড়ে চাপা দিয়ে সেখানে হাত বুলাতে বুলাতে ফিসফিস করে টুনিকে বলল, “ওর মা মারা গেছে। কিছুতেই সেটা মেনে নিতে পারছে না।”
মেয়েটা যেন না শুনতে পারে বাবা সেইভাবে কথাটা বলার চেষ্টা করছে কিন্তু তারপরেও মেয়েটা কথাটা শুনে ফেলল, তখন চিৎকার করে কেঁদে উঠে বলল, “না, আম্মু মারা যায় নাই। তুমি মিথ্যা কথা বলছ। মিথ্যা কথা বলছ।”
বাবাটা তখন প্রায় হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, “ঠিক আছে মা আমি মিথ্যা কথা বলছি। তোমার আম্মু মারা যায় নাই।”
“আমি আম্মুর কাছে যাব।”
“ঠিক আছে মা, আমরা আম্মুর কাছে যাব।”
“এক্ষুনি যাব। এক্ষুনি”
“ঠিক আছে মা। এক্ষুনি তো যাওয়া যাবে না প্লেনের টিকিট কিনতে হবে তারপর যাব। ঠিক আছে? এখন মা এসো কিছু একটা খাও।”
“না, আমি খাব না, খাব না।” বলে মেয়েটা হাউ মাউ করে কাঁদতে থাকে। বাবা তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করতে করতে রেস্টুরেন্টের দিকে এগিয়ে গেল।