দাদি টেলিভিশন দেখছেন। তার পায়ের কাছে বসে ঝুমু খালাও টেলিভিশন দেখছে। এতদিন ঝুমু খালা শুধু কাহিনিটা দেখত, অভিনয় করার সার্টিফিকেট পাওয়ার পর থেকে ঝুমু খালা চরিত্রগুলোর অভিনয় খুবই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করেছে। বেশির ভাগ সময়েই তাদের অভিনয় দেখে সে হতাশ হয়ে মাথা নাড়তে থাকে। কোন ডায়ালগটা কীভাবে বলা উচিত ছিল সে ব্যাপারেও এখন ঝুমু খালার একেবারে সুনির্দিষ্ট মতামত আছে।
দাদি এবং ঝুমু খালা ছাড়াও বাসার বেশির ভাগ বাচ্চারাও আশেপাশে আছে। পচা আলু নামে একটা নতুন খেলা আবিষ্কার হয়েছে। শরীরের চামড়ার খানিকটা দুই আঙুল দিয়ে চিপে ধরে মাঝখানে খোঁচা দিয়ে একটা পচা আলুর অনুভূতি আসবে দাবি করে সবাই যন্ত্রণায় আহ্-উহ্ এবং আনন্দে হি হি করে হাসিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
এরকম সময় ছোটাচ্চু ঘরে ঢুকল এবং সবাই একসাথে জিজ্ঞেস করল, “কী এনেছ ছোটাচ্চু! আজকে কী এনেছ?”
ছোটাচ্চু একটা ধমক দিয়ে বলল, “তোদের সমস্যাটা কী? দেখা হলেই কী এনেছ কী এনেছ? আমি কী আনব?”
প্রায় সবাই একসাথে বলল, “খাবার।”
“তোরা খেতে পাস না নাকি? সবসময় খাই খাই করিস।”
একজন বলল, “ছোটাচ্চু আমাদের এখন বাড়ন্ত বয়স। আমাদের বইয়ে লেখা আছে বাড়ন্ত বয়সে অনেক কিছু খেতে হয়।”
ছোটাচ্চু ঝুমু খালার দিকে তাকিয়ে বলল, “ঝুমু, রান্নাঘরে কী গাজর আছে?”
ঝুমু খালা বলল, “গাজর শেষ। খালি মূলা আছে।”
“ঠিক আছে তাহলে সবার হাতে একটা করে মূলা ধরিয়ে দাও। বসে চাবাতে থাকুক। মূলাতে অনেক ভাইটামিন আছে।”
বাচ্চাগুলো মুখ বিকৃত করে চিৎকার করতে লাগল।
একজন বলল, “বুঝেছি। ছোটাচ্চুর তো চাকরি নাই, বেকার মানুষ সেইজন্যে কিপটেমি করছে।”
ছোটাচ্চু মুখ শক্ত করে বলল, “বেকার হয়েছি তো কী হয়েছে? আমার কী কাজের অভাব আছে?” বলে ছোটাচ্চু তার পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে উঁচু করে ধরল। বলল, “এই দ্যাখ, আজকেই একজন একটা কাজের অফার দিয়েছে। সাথে এডভান্স পেমেন্ট।”
বাচ্চাগুলো একসাথে চিৎকার করে উঠল, “কত টাকা? কত টাকা?”
ছোটাচ্চু চোখ সরু করে বলল, “তোরা সব সময় টাকার এমাউন্ট নিয়ে মাথা ঘামাস কী জন্যে?”
একজন লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “বুঝেছি। টাকা এত কম যে ছোটাচ্চু বলতে লজ্জা পাচ্ছে।”
ছোটাচ্চু গরম হয়ে বলল, “মোটেও না। আমি ইন প্রিন্সিপাল বাচ্চাদের সাথে টাকা-পয়সা নিয়ে কথা বলি না। নেভার।”
বাচ্চারা মুখ টিপে হাসল, ধরেই নিল টাকার পরিমাণ কম বলে বলছে না। টুনি জিজ্ঞেস করল, “ছোটাচ্চু তোমার কাজটা কী?
ছোটাচ্চু একটা চেয়ারে বসে হাসি হাসি মুখে বলল, “কাজটা খুবই ইন্টারেস্টিং। একটা চিঠি খুঁজে বের করে দিতে হবে।”
“চিঠি?”
“হ্যাঁ, একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ চিঠি একজন বয়স্কা মহিলার কাছে এসেছে সেই চিঠিটা এখন আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”
“চিঠিটা কোথায় আছে?”
“ভদ্রমহিলার বাসাতেই আছে। কিন্তু এখন আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমাকে সেটা খুঁজে বের করে দিতে হবে।”
“তুমি সেটা কীভাবে খুঁজে বের করবে?”
ছোটাচ্চু দাঁত বের করে হাসল। বলল, “এর জন্য আমি একজন প্রফেশনালের সাহায্য নেব।”
“প্রফেশনাল?”
“হ্যাঁ।”
একজন জানতে চাইল, “কে প্রফেশনাল?”
ছোটাচ্চু একটা অঙ্গভঙ্গি করে বলল, “তোরাই বল জিনিসপত্র খোঁজার মাঝে সবচেয়ে বড় এক্সপার্ট কে?”
প্রায় সবাই একসাথে চিৎকার করে বলল, “ঝুমু খালা।”
ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ। ঝুমু হচ্ছে জিনিসপত্র খুঁজে বের করার সবচেয়ে বড় এক্সপার্ট। আমি ঝুমুকে নিয়ে যাব। ঝুমু খুঁজে বের করে দেবে। সে জন্যে তাকে প্রফেশনাল ফী দেওয়া হবে।”
ঝুমু খালা যে জিনিসপত্র খুঁজে বের করার মাঝে সবচেয়ে বড় এক্সপার্ট সেই কথাটি অবশ্যি সত্যি। বড় চাচা যখন বলেন, ‘আমার চশমাটা খুঁজে পাচ্ছি না’ ঝুমু খালা সাথে সাথে বাথরুমে গিয়ে টুথপেস্টের পাশ থেকে চশমা বের করে দেয়। মেজো খালা যখন বলে, ‘আমার লাল ব্লাউজটা যে কই গেল?’ তখন ঝুমু খালা বালিশের তলা থেকে লাল ব্লাউজ বের করে আনে। দাদি (কিংবা নানি) যখন বলে আমার মোবাইলটা কই গেল?’ তখন ঝুমু খালা সেটা সোফার চিপা থেকে বের করে আনে। স্কুলে যাবার আগে বাচ্চারা যখন চিৎকার শুরু করে ‘আমার অঙ্ক হোমওয়ার্ক! অঙ্ক হোমওয়ার্ক!’ ‘তখন ঝুমু খালা টেবিলের তলা থেকে সেটা উদ্ধার করে দেয়। ছোটাচ্চু যখন বলে, ‘আমার কলম! আমার কলম!’ তখন ঝুমু খালাকে বেশির ভাগ সময়েই কিছু করতে হয় না। কোনো দিকে না তাকিয়েই বলে, ‘ছোডু ভাই, কানের ওপরে দেখেছেন?’ বেশির ভাগ সময়েই সেটা সেখানে পাওয়া যায়।
ঝুমু খালাকে প্রফেশনাল হিসেবে একটা গুরুত্বপূর্ণ চিঠি বের করার জন্যে নিয়ে যাওয়া হবে শুনে ঝুমু খালার আনন্দ হবে বলে সবাই ভেবেছিল। কিন্তু ঝুমু খালাকে মোটেও সেরকম আনন্দিত দেখাল না। বরং ঝুমু খালা হতাশার ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, “না ছোডু ভাই আপনি আমাকে দিয়া এই কাম করাবার পারবেন না।”
ছোটাচ্চু অবাক হয়ে বলল, “কেন?”
“এই বাসার জিনিসপত্র খুঁইজা বার করা খুবই সোজা। হের কারণ হচ্ছে আমি সবার চরিত্র জানি। কে কুনখানে কুন জিনিসটা ফালাইয়া রাখে আমার থাইকা ভালো করে কেউ জানে না। বড় ভাইজান সবসময় চশমা এইখানে হেইখানে ফালায়া রাখে। আফা আর ভাবিদের সমস্যা বেলাউজ আর কানের দুল। খালার মোবাইল ফোন থাকে সোফাসেটের চিপায়। পোলাপানদের বই খাতা কুনো সময় ঠিক জায়গায় থাকে না; টেবিলের নিচে, বিছানার নিচে, বালিশের নিচে–আমি ধরেন না খুঁইজাই বার করতে পারি। কিন্তুক অন্য বাড়িতে তো সেইটা হইব না।”