শান্তর যেহেতু পড়ায় মন নেই তাই সে কিছুক্ষণ টুম্পাকে জ্বালাতন করে মুনিয়ার পেছনে লেগেছে, ঠিক তখন হঠাৎ বাইরে ঝুমু খালার চিৎকার শোনা গেল, “মার! মার, ইবলিশের বাচ্চারে মার!” তারপরে আঁটার ঝপাং ঝপাং শব্দ শোনা গেল।
ঝুমু খালা কাকে এভাবে ঝটা পেটা করছে দেখার জন্যে সবাই উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই ঝুমু খালা ঝাঁটা দিয়ে কিছু একটাকে পেটাতে পেটাতে তাদের ঘরে ঢুকে গেল। যে প্রাণীটাকে ঝাড় দিয়ে পিটিয়ে ঝুমু খালা মারার চেষ্টা করছে সেটা নিশ্চয়ই ঘরের ভেতর এঁকে বেঁকে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করছে, কারণ ঝুমু খালা নিজেও এঁকে বেঁকে সেটাকে মারার চেষ্টা করে চিৎকার করতে লাগল, “মার। মার বদমাইশের বাচ্চারে মার! খুন করে ফেলব আমি!”
যাকে খুন করার চেষ্টা করছে প্রাণীটা নিশ্চয়ই অনেক চালু, কারণ সেটা এঁকে বেঁকে ঘর থেকে বের হয়ে গেল এবং ঝুমু খালা সেটাকে ঝাঁটাপেটা করার চেষ্টা করতে করতে পিছু পিছু বের হয়ে গেল। সবাই ঘর থেকে বের হয়ে দেখার চেষ্টা করল কিন্তু ঝুমু খালা ততক্ষণে চিৎকার করতে করতে রান্নাঘরের দিকে চলে গিয়েছে।
আবার যখন সবাই টেবিলে এসে বসেছে শান্ত বলল, “বাপরে বাপ, কত বড় ইন্দুর দেখেছিস?’
টুম্পা মাথা নাড়ল, বলল, “আমার ইন্দুর অনেক ভয় করে।”
“ভয়ের কিছু নাই, ঝুমু খালা নিশ্চয়ই ইন্দুরকে সাইজ করে ফেলবে।”
টুনি জিজ্ঞেস করল, “হঁদুরটা কী কালো ছিল, নাকি ছাই রংয়ের ছিল?”
শান্ত বলল, “কালো কুচকুচে কালো।”
টুম্পা বলল, “সাদা।”
প্রমি বলল, “ছাই রংয়ের।”
শাহানা মুচকি হেসে বলল, “শান্ত দেখেছিস। ঘটনাটা আমাদের চোখের সামনে ঘটেছে কিন্তু কেউই স্পষ্ট করে বলতে পারছে না, ইঁদুরটার রং কী ছিল!”
শান্ত একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, “পারব না কেন? এক শবার পারব। কালো রংয়ের। বললাম তো।”
“সবাই কালো বলছে না। একেকজন একেকটা বলছে।”
“কেউ যদি ভালো করে না দেখে সেটা আমার দোষ?”
টুনি, “ঠিক আছে, তাহলে বলো ঝুমু খালা কী রংয়ের শাড়ি পরে এসেছিল?”
শান্ত একটু ভুরু কুঁচকে বলল, “ইয়ে মানে আমি আসলে ইন্দুরটা দেখার চেষ্টা করছিলাম তো তাই শাড়ির রংটা খেয়াল করি নাই।”
“তবুও নিশ্চয় দেখেছ। মনে করার চেষ্টা করো।”
শান্ত চোখ সরু করে টুনির দিকে তাকাল, বলল, “তুই কী করার চেষ্টা করছিস?”
টুনি বইটা দেখিয়ে বলল, “এই বইটা বলেছে মানুষের সামনে কোনো ঘটনা ঘটলেও মানুষ নিজের মত করে দেখে। তারা মনে করে যে দেখেছে, আসলে দেখে না। সেইটা সত্যি কীনা এক্সপেরিমেন্ট করছি। বল ঝুমু খালা কী রংয়ের শাড়ি পরে এসেছিল।”
টুম্পা বলল, “সবুজ।”
শান্ত মাথা নাড়ল, বলল, “হুম মনে হয় সবুজ।
টুনি বলল, “ঠিক আছে চল, ঝুমু খালার কাছে গিয়ে দেখি কী রংয়ের শাড়ি পরে আছে।”
“চল।” সবাই উঠে দাঁড়াল কিন্তু তাদের আর যেতে হলো না কারণ ঝুমু খালা নিজেই তখন চলে এসেছে। কোনো একটা কারণে তার মুখে এগাল-গাল জোড়া হাসি। ঝুমু খালার পরনে একটা হলুদ ডোরা কাটা শাড়ি, সেটা মোটেও সবুজ না।
টুনি বলল, “শান্ত ভাইয়া, এখন তোমার বিশ্বাস হলো যে তোমার চোখের সামনে ঘটনাটা ঘটেছে কিন্তু তবু তুমি সেটা ঠিক করে দেখ নাই।”
শান্ত তবুও মানতে রাজি হলো না, বলল, “আসলে আমি ইন্দুরটার দিকে তাকিয়েছিলাম সেই জন্যে ঝুমু খালার শাড়িটার রং খেয়াল করি নাই।”
“ঠিক আছে। ইঁদুরটা কী রংয়ের ছিল?”
“কালো। কুচকুচে কালো।”
টুনি ঝুমু খালার দিকে তাকাল, তাকে জিজ্ঞেস করল, “ঠিক আছে ঝুমু খালা, তুমি বলো ইঁদুরটা কী রংয়ের ছিল। কালো?”
ঝুমু খালা হি হি করে হাসতে হাসতে প্রায় গড়াগড়ি খেতে লাগল। শান্ত একটু অবাক হয়ে বলল, “কী হলো ঝুমু খালা, তুমি হাসো কেন? বল, ইন্দুরটা কী রংয়ের ছিল?”
ঝুমু খালা অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল, “কোনো ইন্দুর আছিল না। আমি খালি একটিং করছি। ভাব দেখাইছি একটা ইন্দুর মারতাছি।” তারপর আবার হি হি করে হাসতে লাগল।
শান্ত হা করে ঝুমু খালার দিকে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ চেষ্টা করে বলল, “কোনো ইন্দুর ছিল না?”
“না। এই বাসায় ইন্দুর নাই।”
“তাহলে—তাহলে–”
“টুনি গিয়া আমারে জিগাইল আমি কী একটা ইন্দুর মারার একটিং করবার পারমু কী না। সেই জন্যে কইরা দেখাইলাম। কেমন হইছে আমার একটিং?”
অন্য কেউ কিছু বলার আগেই শান্ত বলল, “অনেক ভালো হয়েছে ঝুমু খালা।” তারপর কেমন জানি বোকার মতো হাসতে লাগল।
ঝুমু খালার মুখ আনন্দে ঝলমল করে উঠে, “ভালো হইছে?”
“হ্যাঁ।” শান্ত মাথা নাড়ল, “ঝুমু খালা, তুমি টেলিভিশনের নাটকে একটিং করতে পারবে।”
অন্যরাও মাথা নাড়ল, বলল, কথাটি সত্যি। ঝুমু খালার ইঁদুর মারা নাটকের অভিনয় অনবদ্য। ইচ্ছে করলেই সে টেলিভিশনে একটিং করতে পারবে। বিশেষ করে কাউকে ঝাড়পেটা করার চরিত্রে।
একটু পর টুনি যখন আবার তার মোটা ইংরেজি বইটা খুলে বসেছে তখন শান্ত গলা নামিয়ে বলল, “টুনি।”
“বলো শান্ত ভাইয়া।”
“দেখা শেষ হলে তোর জ্ঞানের বইটা আমাকে একটু দিবি?
টুনি হাসল, বলল, “দেব না কেন! এক শবার দেব। অনেক মজার মজার জিনিস আছে এই বইয়ে।”
টুনি তখনো জানত না এই বইয়ের বিচিত্র জ্ঞানটুকু আর কয়দিন পরেই একটা অন্য কাজে লেগে যাবে। ব্যাপারটা শুরু হয়েছে এভাবে: