“পড়লে কী হয়?”
“তুই জানিস না কী হয়?”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “না জানি না।”
“এখন যদি বড়রা কেউ হাজির হয় তাহলে কী দেখবে?” শান্ত মুখ ভেংচে, বলল, “দেখবে আমাদের এই ছোট টুনি চোখে চশমা পরে এরকম মোটা কঠিন একটা ইংরেজি জ্ঞানের বই পড়ছে। তখন আমাদের বলবে, তোরা এত বড় দামড়া হয়েছিস এখনো আলতু-ফালতু ডিটেকটিভ বই পড়িস, আর এই দ্যাখ আমাদের জ্ঞানী-গুণি টুনি মহারানি এখনই কত মোটা মোটা ইংরেজি বই পড়া শুরু করেছে।”
শান্ত কথাটা শেষ করার সময় জ্ঞানী-গুণী টুনি মহারানি’ কথাটার ওপর আলাদা করে জোর দিল।
টুনি একটু অবাক হয়ে শান্তর দিকে তাকিয়ে রইল। শান্ত তার গলায় আরো কয়েক কেজি বিষ ঢেলে বলল, “বড় মানুষেরা তখন বলবে আমাদের টুনি এখনই এই রকম কঠিন জ্ঞানের বই পড়ছে, যখন আরেকটু বড় হবে তখন নির্ঘাত আস্ত ডিকশনারি পানিতে ভিজিয়ে কোঁৎ করে গিলে ফেলবে–”
টুনি এই বারে শান্তকে কথার মাঝখানে থামাল, বলল, “না, বলবে না।”
“বলবে না?”
“না।”
“কেন বলবে না?”
“তার কারণ আমি এই মোটা মোটা ইংরেজি জ্ঞানের বই পড়ছি না। শুধু এর ছবি দেখছি।”
“শুধু ছবি দেখছিস?”
“হ্যাঁ।”
মনে হলো শুধু ছবি দেখছে শুনে শান্ত একটু শান্ত হলো। কিন্তু তারপরেও সে ছেড়ে দিল না, চোখ ছোট ছোট করে বলল, “শুধু ছবি দেখলে পড়ার মতো ভান করছিস কেন? সবার সামনে ভাব দেখাচ্ছিস?”
টুনি বলল, “শান্ত ভাইয়া, একটা ছবি দেখলে ছবিটা কিসের বোঝা যায় না। ছবিটার নিচে লেখা থাকে ছবিটা কীসের। সেই লেখাটা পড়তে হয়।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ সত্যি।” টুনি তখন বইটা তুলে একটা বাচ্চা ছেলের ছবি দেখিয়ে বলল, “এই দেখো একটা বাচ্চার ছবি। এটা দেখে কিছু বোঝা যাচ্ছে? বোঝা যাচ্ছে না। যদি এর নিচে কী লেখা আছে সেইটা পড় তাহলে বুঝবে এইটা হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম অটিস্টিক বাচ্চার ছবি।”
“দেখি দেখি–” বলে সবাই টেবিলে ঝুঁকে পড়ে পৃথিবীর প্রথম পাওয়া অটিস্টিক বাচ্চার ছবিটা আগ্রহ নিয়ে দেখল।
টুনি পৃষ্ঠা উল্টিয়ে আরেকটা ছবি বের করে দেখিয়ে বলল, “এইটা হচ্ছে মিলগ্রাম আর এইটা হচ্ছে মিলগ্রামের মেশিন।”
একজন জিজ্ঞেস করল, “মিলগ্রামের মেশিন কী করে।”
টুনি বলল, “ইলেকট্রিক শক দেয়।”
টুম্পা বলল, “সত্যি? ইলেকট্রিক শক দেওয়ার মেশিন আছে?”
টুনি বলল, “সত্যি সত্যি ইলেকট্রিক শক দেয় না। শক দেওয়ার ভান করে।”
শান্ত জিজ্ঞেস করল, “কেন ভান করে।”
টুনি গম্ভীর মুখে বলল, “সেইটা জানতে হলে বইটা পড়তে হবে। কিন্তু শান্ত ভাইয়া, তুমি বলেছ আমার মোটা ইংরেজি জ্ঞানের বই পড়া নিষেধ।”
শান্ত একটু থতমত খেয়ে গেল কিন্তু টুনির কথার উত্তরে কী বলবে বুঝতে পারল না। এতক্ষণে আরো অনেকে টুনির মোটা ইংরেজি বইয়ের ওপর ঝুঁকে পড়েছে, টুম্পা একটা ছবির ওপর আঙুল রেখে বলল, “এইটা কীসের ছবি?”
টুনি বলল, “এটা একটা ক্লাসরুমের ছবি। একটা ছাত্র ক্লাসরুমে গোলমাল করছে।”
“কেন একটা ছাত্র ক্লাসরুমে গোলমাল করছে?”
“এটাও ভান। ছাত্রটা একটিং করছে, দেখার জন্য কতজন ঘটনাটা ঠিক করে দেখে।”
শান্ত ভুরু কুচকে বলল, “কতজন ঠিক করে দেখে মানে কী? সবাই তো ঠিক করে দেখবে।”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “নাহ্! কেউই ঠিক করে দেখবে না।”
“মানে?”
“মানে সবাই নিজের মতো করে দেখবে। যার যেটা দেখার ইচ্ছা সে সেইটা দেখবে।”
“কী বলছিস তুই? তোর বইয়ে তাই লেখা?”
“হ্যাঁ। সেইজন্যে যখন কোনো ঘটনা ঘটে যায় আর অন্যেরা বলে আমি স্পষ্ট নিজের চোখে দেখলাম, তাদের কথা বিশ্বাস করা ঠিক না।”
শান্ত টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, “তোর বইটা বিশ্বাস করা ঠিক না। উল্টাপাল্টা কথা লিখা।”
টুনি বলল, “ঠিক আছে।”
টুনি এত সহজে শান্তর কথা মেনে নেবে শান্ত সেটা আশা করে নাই, সে ভাবছিল টুনি শান্তর সাথে এটা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করবে। তর্ক করা শান্তর খুব প্রিয় কাজ। একা একা তর্ক করা যায় না কিন্তু শান্ত তবু চেষ্টা করল, গলা উঁচু করে বলল, “যে বইয়ে লেখা যে একটা ঘটনা নিজের চোখে দেখলেও সে ঠিক জিনিস দেখবে না, তার যেটা ইচ্ছা সেইটা দেখবে–সেই বইয়ের পৃষ্ঠা ছিঁড়ে আগুন ধরানো উচিত।”
টুনি বলল, “ঠিক আছে। কিন্তু আগুন দেওয়ার আগে আম্মুকে জিজ্ঞেস করে নিও। আম্মু অনেক টাকা দিয়ে বইটা কিনেছে।”
“কেমন করে এই বইটা লিখল?”
শান্ত তবুও গজর গজর করতে থাকে, “একটা জিনিস চোখের সামনে হবে কিন্তু কেউ দেখবে না?”
শান্তর কথাকে কেউই বেশি গুরুত্ব দেয় না। কিন্তু যেহেতু অনেকক্ষণ থেকে সে বকর বকর করছে, শাহানা একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “শান্ত, কেউ যখন একটা বই লিখে তখন সে বুঝে-শুনে লিখে। কী লিখেছে, কেন লিখেছে সেটা যদি জানতে চাস বইটা পড়ে দ্যাখ।”
“কক্ষনো না।” শান্ত গরম হয়ে বলল, “এরকম উল্টাপাল্টা বই আমি পড়ব? আমি কী এত বোকা নাকি।”
শাহানা বলল, “না তুই মোটেও এত বোকা না। সেইটাই হচ্ছে সমস্যা।
টুনি এরকম সময় বইটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল। শান্ত জিজ্ঞেস করল, “কই যাস?
“পানি খেতে।”
শান্ত হা হা করে হাসল, বলল, “এই মোটা জ্ঞানের ইংরেজি বই পড়তে গিয়ে তোর গলা শুকিয়ে গেছে!”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “মনে হয়।”
পানি খেতে যেটুকু সময় লাগার কথা টুনির তার থেকে বেশ খানিকটা সময় বেশি লাগল। বোঝা গেল সে শুধু পানি খায়নি আরো কিছু করে এসেছে। তবে কী করে এসেছে সেটা তখন কারো পক্ষে কল্পনা করা সম্ভব ছিল না।