“কিসের দেরি হয়ে গেছে?”
“সাপটা ফেরত দেবার।”
সবুজ প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, বলল, “দিতেই হবে।”
টুনি মাথা নেড়ে বলল, “পুরোটা তো আর ফেরত দেয়া যাবে না।”
“পুরোটা? পুরোটা মানে কী?”
“একটু অপেক্ষা কর। নাটকটা শেষ হোক। দেখবি।”
কাজেই সবুজকে নাটকটা শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হলো।
যখন নাটকটা শেষ হলো এবং বাচ্চারা হাততালি দিয়ে, টেবিলে থাবা দিয়ে, বেঞ্চের ওপর উঠে লাফ দিয়ে চিৎকার করে অনুষ্ঠান শেষ করল তখন টুনি তার হাতের পলিথিনের ব্যাগটা নিয়ে স্টেজে উঠে গলা উঁচিয়ে বলল, “আমি কী তোমাদের সাথে একটু কথা বলতে পারি?”
“বল। বল আপু বল।”
টুনি সাপটা ধরে তাদের ভ্যারাইটি শো রক্ষা করেছে কাজেই তারা যদি টুনির কথা না শুনে তাহলে কার কথা শুনবে?
টুনি বলল, “তোমাদের ভ্যারাইটি শো খুবই ভালো হয়েছে। এত ভালো ভ্যারাইটি শো আমি জীবনেও দেখি নাই।”
বাচ্চারা আবার চিৎকার করে লাফিয়ে টেবিলে থাবা দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করতে লাগল। টুনি তাদের থেমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল, যখন শেষ পর্যন্ত সবাই থেমে গেল তখন টুনি বলল, “আমি তাই তোমাদের সবার জন্য একটা গিফট রেডি করেছি। খুবই ছোট গিফট কিন্তু আমার মনে হয় তোমার এই গিফটা পেলে খুবই মজা পাবে।”
বাচ্চারা এবারে আগ্রহ নিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। টুনি তার পলিথিনের ব্যাগটা ওপরে ধরে বলল, “আজকে আমরা যে রবারের সাপটা ধরেছিলাম আমি সেটাকে টুকরো টুকরো করে এনেছি। সবার জন্যে এক টুকরো। তোমরা এইটাকে রবার হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে।”
কথা শেষ করে টুনি পলিথিনের ব্যাগটা উল্টো করে ধরল এবং তার ভেতর থেকে সাপের টুকরোগুলো ঝুর ঝুর করে স্টেজের ওপর পড়তে লাগল। বাচ্চারা আনন্দে চিৎকার করে সেই টুকরোগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
টুনি বলল, “শুধু সাপের মাথাটা তোমরা নিও না। এইটা তোমাদের সবুজ ভাইয়ার জন্য। তার জন্যেই আজকে তোমরা এই গিফটটা পেয়েছ।”
কেউ একজন সাপের মাথাটা এনে টুনির হাতে দিল। টুনি সেটা নিয়ে সবুজকে ডাকল, বলল, “সবুজ নিয়ে যা। তোর কিসলু ভাইকে বলিস এর থেকে বেশি পাওয়া গেল না।”
সবুজের মুখ প্রথমে ফ্যাকাশে তারপর ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে গেল। তারপর সেখানে লাল-নীল ছোপ ছোপ রং দেখা যেতে থাকে।
.
পরের দিন সবুজ স্কুলে এলো না। এর পরের দিন সে যখন স্কুলে এসেছে তখন তার বাম চোখটা ফুলে আছে এবং চোখের নিচে কালো দাগ। শুধু তাই না স্পষ্ট মনে হলো তার বাম কানটা ডান কান থেকে লম্বা। সবুজ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ক্লাসে এসে পিছনে গিয়ে চুপচাপ বসে রইল, কারো সাথে কথা বলল না।
টুনি কাছে গিয়ে গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কিসলু ভাই?”
সবুজ চোখ লাল করে বলল, “খবরদার কথা বলবি না। খুন করে ফেলব।”
টুনি বলল, “তুই নিজেই বল, দোষটা কার? তোর না আমার?”
সবুজ এবারেও কোনো কথা বলল না। টুনি বলল, “তুই আগে যখন খালি দুষ্টু ছিলি তখন ভালো ছিলি! কেন যে পাজি হতে গেলি?”
সবুজ কোনো কথা না বলে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে মাথা নিচু করে বসে রইল।
হারানো চিঠি
সন্ধ্যেবেলা বাচ্চা-কাচ্চারা বড় টেবিলটা ঘিরে পড়তে বসেছে। এই বাসায় বাচ্চা কাচ্চাদের অন্য কোনো নিয়ম নেই, শুধু এই একটা নিয়ম রয়েছে–সন্ধেবেলা সবাইকে পড়তে বসতে হবে। পড়তে বসে আসলেই পড়ার বই পড়ছে নাকি রগরগে ডিটেকটিভ বই পড়ছে সেটা কেউ খোঁজ করে দেখে না। তবে যারা বড় তারা ছোটদের দিকে নজর রাখে যেন কেউ বেশি বেলাইনে চলে না যায়।
টেবিলে টুনি বিশাল একটা ইংরেজি বই নিয়ে বসেছে, সেটা দেখে শান্ত ধমক দিয়ে বলল, “এই টুনি তুই কী পড়ছিস?’
টুনি বইয়ের মলাটটা দেখে বলল, “হিউম্যান সাইকোলজি।”
শান্ত আরো জোরে ধমক দিয়ে বলল, “পড়ার সময় পাঠ্যবই পড়ার কথা। আলতু ফালতু বই পড়ার কথা না।”
টুনি বলল, “আমার পড়া শেষ। হোমওয়ার্ক কমপ্লিট।”
“সেইজন্যে আলতু ফালতু বই পড়বি?”
“এটা মোটেও আলতু ফালতু বই না।”
টুনি গম্ভীর গলায় বলল, “এটা সাইকোলজির ওপরে ক্লাসিক একটা বই।”
“কোথায় পেয়েছিস এই বই?”
“আম্মু এনেছে।”
“তোর আম্মু নিজে পড়ার জন্যে এনেছে। তোর জন্যে তো আনে নাই? তুই পড়ছিস কেন?”
বাসার কেউই শান্তর কথাবার্তা শুনে কখনোই অবাক হয় না, তাই টুনিও অবাক হলো না। জিজ্ঞেস করল, “কেন? পড়লে কী হয়?”
শান্ত গম্ভীর গলায় বলল, “অনেক কিছু হয়। সিস্টেম নষ্ট হয়।”
টুনি কখনোই কোনো কিছুতে বেশি অবাক হয় না, তার পরেও আজকে সে বেশ অবাক হলো। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “সিস্টেম নষ্ট হয়?”
“হ্যাঁ।” শান্ত গলার স্বর আরো গম্ভীর করে বলল, “সিস্টেম হচ্ছে ছোটরা পড়বে ছোটদের বই। বড়রা পড়বে বড়দের বই। তুই পড়িস ক্লাস ফাইভে–”
টুনি বাধা দিল, বলল, “সেভেন।”
“একই কথা।”
“মোটেও একই কথা না। দুই বছরের পার্থক্য।”
শান্ত বলল, “ঠিক আছে। তুই পড়িস ক্লাস সেভেনে, তুই কেন এত মোটা ইংরেজি উওম্যান সাইকোপ্যাথি বই পড়বি।”
“উওম্যান সাইকোপ্যাথি না। হিউম্যান সাইকোলজি।”
“একই কথা।”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “একই কথা না। হিউম্যান সাইকোলজি হচ্ছে মানুষের ব্রেন আর মন কীভাবে কাজ করে তার ওপরে বই।”
“ঠিক আছে।”
শান্ত মেঘস্বরে বলল, “তুই কেন এত অল্প বয়সে এরকম কঠিন জ্ঞানের বই পড়বি?”