একটা ছোট ছেলে রিনরিনে গলায় জিজ্ঞেস করল, “যদি চাইনিজ সাপ হতো?”
এবারে বেশ কয়েকজন হেসে উঠল। একজন বলল, “চাইনিজ হলে চাইনিজরা এটাকে খেয়ে ফেলতো তাই না আপু?”
টুনি কী বলবে বুঝতে না পেরে বলল, “হ্যাঁ মনে হয় খেয়ে ফেলতো। কিন্তু এইটা রবারের, এইটা কেউ খাবে না।”
এবারে অনেকেই নকল সাপটা দেখার জন্যে টুনির কাছে ছুটে আসতে লাগল। যারা সাহসী তারা ছুঁয়ে দেখল। যারা বেশি সাহসী তারা রীতিমতো হাতে ধরে টিপেটুপে দেখল। টুনি কিছুক্ষণ তাদেরকে দেখতে দিয়ে বলল, “কিন্তু আমি তো তোদের ভ্যারাইটি শো দেখতে এসেছি। রবারের সাপ দেখতে আসি নাই।”
উশকোখুশকো চুলের নাট্যকার মেয়েটা জানালা থেকে নেমে এলো, জিজ্ঞেস করল, “আবার করব?”
“করবি না কেন? শুরু কর।”
সবাই ততক্ষণে নিচে নেমে এসেছে। শুধু প্রেতাত্মা মেয়েটি জানালার শিক ধরে ঝুলে থেকে বলল, “আপু, তুমি সাপটা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে আমরা কেমন করে নাটক করব? আমার সাপ অনেক ভয় করে।”
“রবারের সাপও ভয় পাস?”
“হ্যাঁ। দেখলেই শরীরের মাঝে কী রকম জানি ইলি বিলি করে।”
ইলি বিলি জিনিসটা কী টুনির জানার ইচ্ছা ছিল কিন্তু এখন মনে হয় এইটা নিয়ে আলাপ আলোচনা করার সময় না। সে সাপটা কয়েকবার গোল করে প্যাচিয়ে নিয়ে বলল, “ঠিক আছে আমি এইটা সরিয়ে অন্য জায়গায় রেখে আসছি। তোরা অনুষ্ঠান শুরু কর।“
“ঠিক আছে আপু। ঠিক আছে।” বলে বাচ্চাগুলো আবার ছোটাচ্চুটি শুরু করে দিল।
.
টুনি ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে অফিসের দিকে হেঁটে যেতে থাকে। দূরে একটা গাছের নিচে সবুজ তার সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। টুনি তাদের না দেখার ভান করে তাড়াতাড়ি অফিসের দিকে রওনা দিল।
কিছুক্ষণের মাঝেই আবার অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল। নাচগান আবৃত্তি এবং নাটক। অনুষ্ঠানের শুরুতে দর্শকরা খুবই সভ্য-ভব্য হয়েছিল কিন্তু সাপ নিয়ে হই চই করার কারণে দর্শকরা উত্তেজিত হয়ে একটুখানি জংলি হয়ে গেছে। যেখানে শুধু হাততালি দিলেই হয় সেখানে তারা টেবিলে থাবা দিল। যেখানে টেবিলে থাবা দিলেই হয় সেখানে চিৎকার করল, আর যেখানে একটুখানি চিৎকার করা যায় সেখানে তারা বেঞ্চে উঠে লাফালাফি করল। অনুষ্ঠান খুবই ভালো হলো শুধু কবিতা আবৃত্তি করার সময় একজন মাঝামাঝি এসে ভুলে গিয়ে অন্য একটা কবিতা বলে ফেলল। নাচটাও খুবই ভালো হতো কিন্তু মাঝখানে শাড়ি খুলে যাওয়ার কারণে সেটাকে তাড়াতাড়ি শেষ করে দিতে হলো। দর্শকরা সবচেয়ে পছন্দ করল নাটকটা, কিন্তু ভৌতিক নাটক হওয়ার পরও অভিনেতা-অভিনেত্রীরা মাঝে মাঝেই হি হি করে হাসতে শুরু করার কারণে নাটকটাতে ভৌতিক ভাব না এসে একটা হাসির ভাব চলে এসেছিল। শুধু তাই না এতবার রিহার্সাল দেওয়ার পরও বাচ্চাগুলো ডায়লগ ভুলে যাচ্ছিল তখন তারা বানিয়ে বানিয়ে ডায়লগ দিতে শুরু করল। বানানো ডায়লগগুলো আসল ডায়লগ থেকেও হাসির হওয়ার কারণে শেষের দিকে আসল ডায়লগ না বলে সবাই বানিয়ে বানিয়ে বলতে শুরু করল, সেইজন্যে নাটকটা একটু লম্বা হয়ে গেল। উশকোখুশকো চুলের নাট্যকার রেগে মেগে স্টেজে এসে ধাক্কাধাক্কি করার কারণে হঠাৎ করে নাটকটা শেষ হয়ে গেল।
টুনি অবশ্যি নাটকের শেষের দিকে মনোযোগ দিতে পারছিল না কারণ তখন কোথা থেকে সবুজ এসে হাজির হয়েছে। সে টুনির পাশে দাঁড়িয়ে খুবই কাচুমাচু মুখ করে ইনিয়ে-বিনিয়ে কথা বলতে শুরু করল, জিজ্ঞেস করল, “সাপটা কই?” (টুনি পুরো ব্যাপারটা বোঝার পরেও না বোঝার ভান করল। জিজ্ঞেস করল, “সাপ? কোন সাপ?”
“ঐ যে স্টেজের নিচে ছিল। রবারের সাপ।”
“ও!” টুনি বোঝার ভান করল, বলল, “কেন?”
“না। মানে ইয়ে–জানতে চাচ্ছিলাম।”
“বাচ্চারা দেখে ভয় পায়, সেইজন্যে লুকিয়ে রেখেছি।”
সবুজ মাথা চুলকে আমতা আমতা করে বলল, “সাপটা দিবি আমাকে?”
টুনি চোখ কপালে তুলে অবাক হওয়ার ভান করে বলল, “দেব? তোকে? তোকে কেন দেব?”
“সাপটা আসলে আমার। আমি এনেছিলাম।”
“তোর? তুই রেখেছিলি?”
সবুজ বোকার মতো হাসার ভঙ্গি করে বলল, “হ্যাঁ। এমনি বাচ্চাদের সাথে একটু মজা করার জন্য।”
টুনি চোখ লাল করে বলল, “একটু মজা করার জন্য? বাচ্চারা কত কষ্ট করে সবকিছু রেডি করেছে আর তুই এসে দিয়েছিস সবকিছু নষ্ট করে? তুই কী রকম মানুষ?”
সবুজ অপরাধীর মতো ভঙ্গি করে বলল, “আসলে গাধামো হয়েছিল। আর হবে না। খোদার কসম।”
“ঠিক আছে। আর যেন না হয়। যদি হয় তাহলে কিন্তু খবর আছে।”
সবুজ মাথা নেড়ে দাঁড়িয়ে রইল, একটু পরে, উশখুশ করে বলল, “দিবি না?”
“কী দেব না?”
“আমার সাপটা?”
“আমি তো জানতাম না এটা তোর সাপ! আমি তো আমি তো–”
সবুজ আতঙ্কিত গলায় বলল, “তুই কী?”
“আমি তো ঠিক করে রেখেছি এই বাচ্চাদের সাপটা গিফট দেব।”
সবুজ ফ্যাকাসে মুখে জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “না না না। বাচ্চাদের দিস না। তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।”
“কেন?”
“সাপটা আসলে আমার নিজের না। কিসলু ভাইয়ের।”
“কিসলু ভাইটা কে?”
“আমাদের পাড়ায় থাকে। বডি বিল্ডার।”
সবুজ শুকনো গলায় বলল, “আমি এক দিনের জন্য ধার এনেছিলাম। বলেছিলাম আজকে বিকেলে ফেরত দেব। ফেরত না দিলে কিসলু ভাই অনেক রাগ করবে।”
টুনি চিন্তিত মুখে বলল, “দেরি হয়ে গেছে মনে হয়।”