প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমরা দুই মিনিট অপেক্ষা করো, তোমাদের কী লাগবে না লাগবে আমি দেখছি।”
তারপর সবুজের দলটার দিকে তাকিয়ে বললেন, “এখন তোমরা বল কী জন্যে এসেছ।”
সবুজ একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল, “ম্যাডাম আমরা একটা কমপ্লেন নিয়ে এসেছি।”
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম ভুরু কুচকে বললেন, “দাঁড়াও, তুমি সবুজ না?”
সবুজ মাথা নাড়ল। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম অন্যদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আর তোমরা লাল নীল বেগুনি–”
সবুজের সাঙ্গোপাঙ্গ ম্যাডামের ঠাট্টাটা ধরতে পারল না। ছোট বাচ্চারা ঠিকই ধরতে পারল এবং তারা আবার হি হি করে হেসে উঠল তখন সবুজ আবার তাদের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাল এবং বাচ্চাগুলো আবার ভয় পেয়ে হাসি বন্ধ করল।
সবুজ আরেকবার কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল, “ম্যাডাম, আমরা একটা কমপ্লেন করতে এসেছি। আমাদের ক্লাসে–”
ম্যাডাম হাত তুলে থামালেন, বললেন, “দাঁড়াও, দাঁড়াও। তুমি আরেকবার তোমার দলবল নিয়ে কমপ্লেন করতে এসেছিলে না? পরে দেখা গেল তুমিই হচ্ছ কালপ্রিট? তুমি বুঝে গিয়েছ অন্য কেউ কমপ্লেন করার আগেই তুমি কমপ্লেন করে ফেলবে, তাহলে পরে তোমাকে ধরা যাবে না–অফেন্স ইজ দা বেস্ট ডিফেন্স?”
সবুজ আমতা আমতা করে বলল, “না, মানে ইয়ে ম্যাডাম–”
“এর আগেরবার একটা চেয়ার ভেঙেছিলে। এইবারে কী ভেঙেছ?”
সবুজ আমতা আমতা করতে লাগল। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম টুনিকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি জান? কিছু কী ভেঙেছে?”
“ক্লাস রুমে ভাঙা কাঁচ। জানালার কাঁচ ভেঙেছে কিন্তু কে ভেঙেছে আমি দেখি নাই।”
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম হাল ছেড়ে দেবার ভঙ্গি করে নিজের মাথা কিছুক্ষণ চেপে ধরে রেখে বললেন, “শোনো সবুজ। তোমাদের বয়সী ছেলেমেয়েরা একটু আধটু দুষ্টুমি করবে সেটা আমি মেনেই নিয়েছি। আমি সেগুলো দেখেও না দেখার ভান করি। কিন্তু দুষ্টু এক জিনিস আর পাজি অন্য জিনিস। আগে তুমি দুষ্টু ছিলে, এখন তোমার প্রমোশন হয়েছে, তুমি দুষ্ট্র থেকে পাজি হয়েছ। পাজি ছেলেমেয়েদের কীভাবে সোজা করতে হয় আমি কিন্তু সেটা জানি।”
সবুজ আমতা আমতা করে বলল, “কিন্তু ম্যাডাম আগে আমি শুরু করি নাই। জিজ্ঞেস করে দেখেন—”
“কী শুরু কর নাই?”
সবুজ বুঝতে পারল কথাটা বলা ঠিক হয় নাই। তাই এবারে মুখ বন্ধ করে রাখল।
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আবার জিজ্ঞেস করলেন, “কী শুরু করো নাই?”
টুনি সাহায্য করল, বলল, “ক্লাসে একটু মারামারি হয়েছে, সবুজ মনে হয় তার কথা বলছে। তাই না’রে সবুজ?”
সবুজ মাথা নাড়ল। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আবার নিজের মাথা চেপে ধরলেন, বললেন, “শুধু জানালার কাঁচ ভাঙেনি, মারামারিও হয়েছে?”
টুনি আবার সাহায্য করার চেষ্টা করল, বলল, “বেশি সিরিয়াস মারামারি না, হালকা একটু হাতাহাতি। তাই না’রে সবুজ?”
সবুজ এবারে জোরে জোরে মাথা নাড়ল। টুনি বলল, “নিজেরা নিজেরা আবার মিটমাট করে নিয়েছে। তাই না’রে সবুজ?”
সবুজ এবারে আরো জোরে জোরে মাথা নাড়ল। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “দেখো সবুজ, তোমরা বড় হয়েছ, আমি আশা করব তোমরা দায়িত্বশীল হবে। কিন্তু উল্টোটা হচ্ছে তোমরা দিনে দিনে দায়িত্বহীন হয়ে যাচ্ছ।”
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম ছোট বাচ্চাদের দলটিকে দেখিয়ে বললেন, “অথচ দেখো, এই ছোট বাচ্চারা মাত্র ক্লাস টুতে পড়ে তারা নিজেরা নিজেরা একটা অনুষ্ঠান অর্গানাইজ করছে। গান কবিতা আবৃত্তি করছে। নিজেরা নাটক লিখেছে সেটা অভিনয় করবে। এদেরকে দেখে তোমার লজ্জা হওয়ার কথা।”
সবুজ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল, খুব লজ্জা হলো বলে মনে হলো না। বাচ্চাগুলোর ওপর উল্টো তার খুব রাগ হলো সেটা অনুমান করা যায়। টুনি দেখল সবুজের চোখ দিয়ে রীতিমতো আগুন বের হতে শুরু করেছে।
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, “যাও এখান থেকে। বিদায় হও। আর শুনে রাখো, তোমার বিরুদ্ধে যদি আর কোনোদিন কোনো নালিশ আসে তাহলে আমি তোমাকে সিধে করে দেব। মনে থাকবে?”
সবুজ মাথা নাড়ল। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, “এখন দূর হও আমার সামনে থেকে।”
সবাই বের হয়ে গেল, টুনিও পিছু পিছু বের হয়ে এলো। বাইরে বের হয়েই সবুজ হিংস্র গলায় বলল, “আমি আন্ডাবাচ্চাদের নাটক করা বের করছি।”
টুনি বলল, “কী বললি? তুই কী বললি?”
সবুজ মুখ শক্ত করে বলল, “কিছু বলি নাই।”
“বলেছিস। আমি শুনেছি।”
“যদি শুনেছিস তাহলে আবার আমাকে জিজ্ঞেস করছিস কেন?” বলে সবুজ গট গট করে দলবল নিয়ে হেঁটে ক্লাসের দিকে এগিয়ে গেল।
টুনি একটু দুশ্চিন্তার মাঝে পড়ে গেল। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম ঠিকই বলেছেন, সবুজ আগে দুষ্টু ছিল। এখন প্রমোশন হয়ে পাজি হয়েছে। দুষ্টু ছেলেমেয়েদের নিয়ে সমস্যা হয় না কিন্তু পাজিদের নিয়ে অনেক সমস্যা। এই পাজি সবুজটা ছোট ছোট ক্লাস টুয়ের ছেলেমেয়েদের পেছনে লেগে গেলে তো অনেক ঝামেলা হবে।
টুনি স্কুলের বারান্দায় চিন্তিত মুখে বসে রইল। বাচ্চাগুলোকে একটু সাবধান করে দিতে হবে।
.
দেখতে দেখতে এক সপ্তাহ পার হয়ে গেল। ক্লাস টুয়ের বাচ্চাগুলো পুরো সপ্তাহ রিহার্সাল করেছে। তাদের উৎসাহের কোনো সীমা নেই। যেদিন ভ্যারাইটি শো
সেদিন প্রিন্সিপাল ম্যাডাম তাদের সকলের ক্লাস ছুটি দিয়ে দিয়েছেন। তাই তারা সকাল থেকে স্টেজ সাজাচ্ছে। নানা রকম রঙিন কাগজ কেটে কেটে স্কচ টেপ দিয়ে পেছনে লাগানো হচ্ছে, স্টেজটা একটা ভ্যারাইটি শো’-এর স্টেজ মনে না হয়ে বিয়েবাড়ির মত দেখাচ্ছে কিন্তু সেটা নিয়ে কারো খুব মাথাব্যথা নেই।