টুনি অবাক হয়ে বলল, “প্রিন্সিপাল ম্যাডামের কাছে? কেন?”
“আমরা একটা ভ্যারাইটি শো করব। সেইটার পারমিশান নেবার জন্য।”
“তোরা ভ্যারাইটি শো করবি? সেইটা কী জিনিস?”
এবারে একটা ছেলে উত্তর দিল। তার মনে হয় ঠাণ্ডা বেশি লাগে কারণ তার একটা সোয়েটারের ওপরে একটা জ্যাকেট এবং গলায় মাফলার। সে খুবই গম্ভীর গলায় বলল, “ভ্যারাইটি শো হচ্ছে যেখানে নাচ-গান-আবৃত্তি নাটক এই সব হয়।”
“তোরা এই সব করবি?”
এবারে পুরো দলের সবাই একসাথে গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল।
একজন যোগ করল, “নাটকও হবে।”
চশমা পরা মেয়েটা বলল, “হ্যাঁ। নাটকও হবে।”
“নাটকের নাম কী?”
“প্রেতাত্মার অট্টহাসি। ভৌতিক নাটক।”
টুনি চমৎকৃত হলো। জিজ্ঞেস করল, “কার লেখা নাটক?”
“পূর্ণা।” বলে কয়েকজন পূর্ণাকে সামনে ঠেলে দিল। পূর্ণারও চোখে চশমা এবং সত্যিকারের নাট্যকারের মতো তার উশকোখুশকো চুল। তবে নাট্যকারের মতো সে গম্ভীর নয়, তার চোখে-মুখে লাজুক হাসি।
“কী সাংঘাতিক।” টুনি হাতে কিল দিয়ে বলল, “যা তোরা প্রিন্সিপাল ম্যাডামের কাছে। পারমিশান নিয়ে আয়।”
ছোট ছোট বাচ্চা কাচ্চাদের মোটামুটি বড়োসড়ো দলটি আবার গুটি গুটি পায়ে প্রিন্সিপাল ম্যাডামের অফিসের দিকে রওনা দিল।
.
ক্লাসরুমে ঢুকে টুনি দেখল সেখানে একটা জটলা। নিজের সিটে ব্যাগটা রেখে দেখল মেঝেতে কাঁচের টুকরো এবং তাদের ক্লাসের কয়েকজন ছেলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে। এরা এই ক্লাসের দুষ্টু ছেলেগুলোদের কয়েকজন। এদের উৎপাতে মোটামুটি সবাই অতিষ্ঠ। কী হচ্ছে বোঝার জন্যে টুনি দাঁড়িয়ে গেল তখন দুজন মারামারি শুরু করে দিল। কয়েকজন তাদের টেনে আলাদা করে দেয়। যে বেশি মারকুটে নাম সবুজ, সে চিৎকার করে বলল, “আমি এক্ষুনি যাব প্রিন্সিপাল ম্যাডামের কাছে নালিশ করতে। তোরা সাক্ষী। তোরা বল, কে আগে শুরু করেছে? কে?”
যাদেরকে সাক্ষী মানা হয়েছে তাদের কাউকেই কে আগে শুরু করেছে সেটা নিয়ে মাথা ঘামাতে দেখা গেল না। একজন বলেই ফেলল, “দিন-রাত মারামারি করিস লজ্জা করে না? আবার আগে-পরে নিয়ে ঘোট পাকাস?”
আরেকজন বলল, “জানালার কাঁচ ভেঙেছিস, এখন ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকবে–”
আরেকজন বলল, “সেই জন্যেই তো ভেঙেছে, যেন ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকে আর আমরা ক্লাস করতে না পারি।”
সবুজ নামের মারকুটে ছেলেটা হিংস্র মুখে বলল, “আমি গেলাম প্রিন্সিপাল ম্যাডামের কাছে নালিশ করতে। তোরা কে যাবি আমার সাথে?”
টুনি বলল, “আমি যাব।”
সবুজ অবাক হয়ে বলল, “তুই? তুই কেন যাবি?”
“তুই না সাক্ষী চাইছিস। আমি সাক্ষী দেব।”
সবুজ থতমত খেয়ে বলল, “তুই-তুই-তুই কী সাক্ষী দিবি?”
“যেটা দেখেছি সেটা।”
সবুজকে আড়ালে অনেকেই ষণ্ডা সবুজ ডাকে। তার সাথে আরো কয়েকজন থাকে তারা বলল, “আয় সবুজ আমরা যাব তোর সাথে। কুনো চিন্তা নাই।”
তারা টুনিকে নিতে চাইছিল না কিন্তু টুনি তাদের পিছু পিছু গেল। স্কুলের প্রিন্সিপাল ম্যাডাম খুবই সুইট, কোনো দরকার ছাড়াই তার সাথে যখন খুশি দেখা করতে যাওয়া যায়।
প্রিন্সিপাল খুলল, “আসতে পর দরজার ঝোল
প্রিন্সিপাল ম্যাডামের অফিসের দরজার ঝোলানো পর্দা সরিয়ে সবুজের দলের একজন বলল, “আসতে পারি ম্যাডাম?”
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম দরজায় দাঁড়ানো সবুজ এবং তার দলবলের দিকে তাকিয়ে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “আমার বলার ইচ্ছা করছে, না, তোমরা আসতে পার না। কিন্তু সেইটা তো বলা যাবে না। তোমাদেরকে আসতে দিতে হবে। এসো। এসে এই পাশে দাঁড়াও।”
সবাই যখন ভেতরে ঢুকল তখন প্রিন্সিপাল ম্যাডাম টুনিকে দেখতে পেলেন, একটু অবাক হয়ে বললেন, “তুমি? তুমি এদের সাথে কেন?”
টুনি মুখ কাচুমাচু করে বলল, “এইখানে কী হয় দেখতে চাচ্ছিলাম।”
“ও আচ্ছা, সার্কাস দেখতে এসেছ?”
“অনেকটা সেইরকম।”
সবুজ এবং তার দল চোখ পাকিয়ে টুনির দিকে তাকাল, টুনি সেটাকে বেশি গুরুত্ব দিল না। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, “সার্কাস দেখার জন্যে একটু অপেক্ষা করতে হবে। আমি এই সুইট বাচ্চাগুলোর সাথে কথা বলছি। খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা। তোমরা কী জানো এই বাচ্চাগুলো নিজেরা নাটক লিখেছে, নিজেরা অভিনয় করবে, নিজেরা ডিরেকশান দেবে?”
টুনি বলল, “জানি ম্যাডাম।”
“কী অসাধারণ!” তারপর বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন, “হ্যাঁ যেটা বলছিলাম। অবশ্যই আমি তোমাদের পারমিশান দেব। পারমিশানের জন্য একটা এপ্লিকেশন পর্যন্ত লিখে এনেছ, সেখানে কোনো বানান পর্যন্ত ভুল নেই শুধু একটা শব্দের প্রয়োগ পুরোপুরি ঠিক হয় নাই–”
উশকোখুশকো চুলের নাট্যকার মেয়ে রীতিমতো ভুরু কুচকে বলল, “কোন শব্দ ম্যাডাম?”
“তোমরা লিখেছ এই স্কুলে বিদ্যা আরোহণের পাশাপাশি আমরা উৎসব করতে চাই। এখানে আরোহণ হবে না, হবে আহরণ। বিদ্যা আহরণ করে আর গাছে আরোহণ করে। বুঝেছ?”
নাট্যকারের সাথে সাথে অন্যরাও মাথা নাড়ল। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম অন্যপাশে দাঁড়ানো সবুজের দলটি দেখিয়ে বললেন, “এই যে এরা সবসময় বাদরামো করে। কাজেই আমরা বলতে পারি এই বানরের দল বৃক্ষে আরোহণ করবে আর তোমরা বিদ্যা আহরণ করবে–”
এই তুলনামূলক আলোচনায় বাচ্চাগুলো খুবই আনন্দ পেল এবং কয়েকজন মুখে হাত দিয়ে খিক খিক করে হেসে ফেলল। সবুজ এবং তার দলবল চোখ পাকিয়ে বাচ্চাদের দিকে তাকাল এবং বাচ্চাগুলো সাথে সাথে ভয়ে হাসি বন্ধ করে ফেলল।