তিন তালার ক্লাসরুমগুলোর সামনে দিয়ে যাবার সময় চাপা অন্ধকার থেকে ছায়ার মতো একজন এগিয়ে এলো, এক মুহূর্তের জন্যে টুনি চমকে ওঠে, চাপা গলায় বলে, “রাজু?”
“হ্যাঁ। তুই এখানে কী করছিস?”
“তুই কথা রাখিস নাই। তুই আমাকে কথা দিয়েছিলি বাসা থেকে পালাবি না।”
“উঁহু।” রাজু চাপা গলায় বলল, “আমি বাসা থেকে পালাব না বলি নাই। আমি বলেছিলাম নিজেকে বিপদের মাঝে ফেলব না। আমি কোনো বিপদে পড়ি নাই। মশার কামড়ে কোনো বিপদ নাই।”
“আছে। ডেঙ্গু না হলে চিকুনগুনিয়া অনেক বড় বিপদ।”
“মশার কয়েল আছে।”
“ফাজলামি করবি না।” টুনি কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে বলল, “কী খাচ্ছিস? চিড়া?”
“হ্যাঁ।”
“আর কিছু?”
“নাহ্।”
“সময় কাটাস কেমন করে?”
“দিনের বেলা বই পড়ি?”
“রাত্রে?”
“চিন্তা করি?”
“কী চিন্তা করিস?”
“এইতো। এইটা সেইটা।”
“মাহতাব চাচার ভূতের সাথে দেখা হয়েছে?”
“এখনো হয় নাই।” রাজু কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, “তুই এখানে এসেছিস কীভাবে? তোকে কে বলেছে?”
“তোর, আব্বু-আম্মু।”
“সত্যি? রাজুর গলার স্বরে কেমন যেন ঠাট্টার মতো শোনাল, “আমি ভেবেছিলাম এখনো হয়তো জানেই না যে আমি বাসায় নাই।”
টুনি বলল, “ফাজলামি করবি না। তোর আব্বু-আম্মু পাগলের মতো হয়ে গেছে।”
“তারা কোথায়? স্কুলে এসেছে?”
“না। আমি আনি নাই। বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি। বলেছি তোকে খুঁজে পেলে জানাব।”
“ও।“
দুজন আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর টুনি নরম গলায় বলল, “চল, এখন যাই।”
“বাসায় যাওয়ার ইচ্ছা করছে না।”
“ঠিক আছে তোর বাসায় যেতে হবে না। আমাদের বাসায় চল।”
“উঁহু। সবার সামনে লজ্জা করবে।”
“কোনো লজ্জা নাই। আমাদের বাসায় কোনো নরমাল মানুষ নাই। সব এবনরমাল। গেলেই বুঝতে পারবি। আয়।”
রাজু মাথা নাড়ল, বলল, “যেতে চাই না।”
টুনি অন্ধকারে হাত বাড়িয়ে রাজুর হাত ধরার চেষ্টা করল, বলল, “আয়। দুই দিন থেকে না খেয়ে আছিস। আমাদের বাসায় গিয়ে গরম পানি দিয়ে গোসল করে ভালো করে খাবি। ঝুমু খালা অসাধারণ রান্না করতে পারে।”
“ঝুমু খালা কে?”
“গেলেই দেখবি। আয়। তোর কোনো লজ্জা নাই। আমাদের বাসায় সবাই পাগল। সবাই তোর জন্যে অপেক্ষা করছে?”
“সবাই? আমার জন্য অপেক্ষা করছে?”
“হ্যাঁ।”
“কেন?”
“মনে হয় কেমন করে বাসা থেকে পালাতে হয় সেটা তোর কাছ থেকে শিখবে।”
এই প্রথম রাজু হেসে ফেলল।
একটু পরেই টুনি যেভাবে নিঃশব্দে ঢুকেছিল ঠিক সেভাবে নিঃশব্দে রাজুকে নিয়ে বের হয়ে এলো। মাহতাব চাচা টের পেল না কিন্তু ছোটাচ্চু চোখের কোনো দিয়ে ঠিকই লক্ষ করল। ছোটাচ্চু মাহতাব চাচার একটা ভৌতিক অভিজ্ঞতার মাঝামাঝি ছিল, সেটাকে এবারে দ্রুত শেষ করে দিল। হাত তুলে মাহতাব চাচাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “থামেন থামেন।”
মাহতাব চাচা অবাক হয়ে বলল, “কী হয়েছে?”
“ভয় করছে।”
“ভয় করছে?”
“হ্যাঁ, এই দেখেন হাত-পা কাঁপছে।” ছোটাচ্চু বেশ জোরে জোরে তার হাত কাঁপাতে থাকল।
মাহতাব চাচা বেশ অবাক হয়ে ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল। ছোটাচ্চু বলল, “আমি একলা থাকি, রাত্রে ভয় পেতে পারি। আরেকদিন দিনের বেলা এসে বাকিটা শুনব। আমার বন্ধুটা সিগারেট কিনে আসার কথা ছিল, সে আসল না। এখন একলা বাসায় যেতে হবে।”
“কেন আসল না?”
“মনে হয় ভয়ে। তার ভূতের অনেক ভয়।”
ছোটাচ্চু মাহতাব চাচাকে আর বেশি কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বের হয়ে এলো। ছোটাচ্চু চলে যাবার পর মাহতাব চাচার মনে হলো কোন পত্রিকায় কবে তার ভূত সংক্রান্ত ইন্টারভিউ ছাপা হবে সেটা জিজ্ঞেস করা হলো না।
.
রাজুকে বাসায় এনে টুনি তার আবু-আম্মুকে ফোন করে জানালো যে তাকে পাওয়া গেছে তবে আজকের রাতটা এই বাসাতেই কাটাবে। আম্মু রাজুর সাথে টেলিফোনে কথা বলতে চাইলেন, টুনি তখন রাজুকে টেলিফোনটা ধরিয়ে দিল। ওই পাশে তার আম্মু কী বললেন শোনা গেল না, এই পাশে রাজু অবশ্যি হু-হা ছাড়া আর কিছু বলল না। সে যখন সাবধানে চোখ মোছার চেষ্টা করল তখন সবাই সেটা না দেখার ভান করে সরে গেল।
রাজু গোসল করে শান্তর ঢলঢলে ঘুমের কাপড় পরে এলো। ঝুমু খালা তার জন্যে খাবার গরম করল। আলাদা করে গরম ভাত রান্না করল। ছোটাচ্চু একটা আইসক্রিমের প্যাকেট কিনে নিয়ে এলো। ডাইনিং টেবিলে সবাই রাজুর চারপাশে বসে আইসক্রিম খেতে খেতে কে কীভাবে বাসা থেকে পালাবে এবং বাসা থেকে পালিয়ে কে কোথায় যাবে সেটা নিয়ে আলোচনা করতে লাগল। বাসা থেকে পালিয়ে যাবার সময় সাথে কী কী নিতে হবে সেটা নিয়ে আলোচনা হলো এবং পুরো সময়টা ঝুমু খালা এই ব্যাপারে সবাইকে নানা ধরনের উপদেশ দিতে থাকল।
রাজুকে স্বীকার করতেই হলো, টুনি তাকে একটুও বাড়িয়ে বলেনি, এই বাসার মানুষগুলো আসলেই পাগল, এবনরমাল!
সে মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আহা, তার পরিচিত সবাই যদি এরকম এবনরমাল হতো।
সাপ
স্কুলে ঢুকে টুনি যখন নিজের ক্লাসরুমের দিকে যাচ্ছে তখন লক্ষ করল একেবারে গেন্দা সাইজের বেশ কয়েকজন ছেলেমেয়ে খুবই গম্ভীর ভঙ্গিতে কোথায় জানি হেঁটে যাচ্ছে। বাচ্চাগুলো দেখেই বোঝা যাচ্ছে এরা ক্লাস ওয়ান কিংবা টুয়ের বেশি হবে না। টুনি জিজ্ঞেস করল, “এই! তোরা কই যাস?”
দলটার সামনের দিকে চশমা পরা একটা মেয়ে মুখটা গম্ভীর করে বলল, “প্রিন্সিপাল ম্যাডামের কাছে।”