“তুমি জান সে কোথায় আছে?”
“এখনো জানি না, কিন্তু মনে হয় বের করতে পারব।”
রাজুর আম্মু তখন আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগলেন। টুনি কী করবে বুঝতে না পেরে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। সে জানে একটু পরে আবার সবকিছু ভুলে গিয়ে দুজনে ঝগড়া করবেন। বড় মানুষেরা এরকম বোকা কেন?
.
রাজুর আব্বু-আম্মু চলে যাবার পর সবাই এসে টুনিকে ঘিরে ধরল। তারা জানালার পাশে বসে সবকিছু শুনেছে এখন আরো শুনতে চায়। কী হয়েছে জানতে চায়। ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “ছেলেটা কোথায় আছে জানিস?”
ঝুমু খালা বলল, “নিশ্চয়ই গ্রামের বাড়ি। এই বয়সী ছেলেরা বেশি দূর যাইতে পারে না।”
শান্ত বলল, “সেন্ট মার্টিনস। আমি যদি কখনো বাড়ি থেকে পালাই তাহলে সেন্ট মার্টিনস যাব। আগে থেকে বলে রাখলাম।”
টুম্পা বলল, “উঁহু। নিশ্চয়ই কোনো বন্ধুর বাসায় গেছে।”
টুনি বলল, “না। আমার মনে হয় স্কুলে লুকিয়ে আছে।”
সবাই এক সাথে চিৎকার করে বলল, “স্কুলে?”
প্রমি বলল, “ইয়া আল্লাহ। কী বোরিং। কেউ কখনো পালিয়ে স্কুলে যায়?”
টুনি ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে বলল, “ছোটা, তুমি আমাকে একটু স্কুলে নিয়ে যাবে?”
সবগুলো বাচ্চা এক সাথে চিৎকার করে বলল, “আমিও যাব। আমিও যাব।”
টুনি বলল, “না, না, এটা নিয়ে মোটেও হইচই করা যাবে না। যদি জানাজানি হয় রাজু স্কুলে থাকছে–তার অনেক ঝামেলা হতে পারে।”
ছোটাচ্চু ভুরু কুচকে বলল, “তাহলে? তাকে খুঁজে বের করবি কীভাবে?”
“তুমি গার্ড চাচাকে একটু ব্যস্ত রাখবে আমি ভেতরে গিয়ে রাজুকে খুঁজে বের করে নিয়ে আসব।”
“আমি? আমি কীভাবে ব্যস্ত রাখব?”
“গার্ড চাচা বিশ্বাস করে আমাদের স্কুলে ভূত আছে। তুমি ভূত নিয়ে আলোচনা করতে পার।”
ছোটাচ্চু চোখ কপালে তুলে বলল, “আমি! এই রাত্রে গার্ডের সাথে ভূত নিয়ে আলোচনা করব?”
“সমস্যা কী? ভান করবে তুমি সাংবাদিক।”
.
কাজেই ঘণ্টা খানেক পর দেখা গেল ছোটাচ্চু টুনিকে নিয়ে তাদের স্কুলে হাজির হয়েছে। টুনি একটু দূরে লুকিয়ে রইল তখন ছোটাচ্চু গিয়ে স্কুলের গেটে ধাক্কা দিল। ভেতর থেকে একজনের গলার শব্দ শোনা গেল, “কে?”
ছোটাচ্চু বলল, “আমি।”
“আমি কে?”
ছোটাচ্চু বলল, “আমাকে চিনবেন না। আমি একজন সাংবাদিক।”
এবারে স্কুলের গার্ড মাহতাব চাচা ভেতর থেকে তালা খুলে উঁকি দিল। ছোটাচ্চু এগিয়ে গিয়ে বলল, “আপনার সাথে কথা আছে।”
“কী কথা?”
“ভেতরে এসে বলি। গেটে দাঁড়িয়ে বলা যাবে না।”
মাহতাব চাচা খানিকটা অনিচ্ছা এবং খানিকটা বিরক্তি নিয়ে গেট থেকে সরে দাঁড়াল। মাহতাব চাচা আবার গেটে তালা দিতে চাচ্ছিল তখন ছোটাচ্চু বলল, “তালা মারবেন না। খোলা থাকুক।”
“কেন?”
“আমার ফটোগ্রাফার সিগারেট কিনতে গেছে। সে আসবে।”
মাহতাব চাচা সন্দেহের চোখে ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল, তারপর বলল,
গেটের পাশে ছোট একটা ঘর, এখানে মনে হয় মাহতাব চাচা থাকে। ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “এইটা আপনার ঘর?”
“হ্যাঁ।”
“আসেন, আপনার ঘরে বসি। একটু বসে কথা বলি।” বলে মাহতাব চাচাকে কোনো সুযোগ না দিয়ে তার ঘরে ঢুকে গেল এবং ঠিক তখন টুনি সুড়ৎ করে গেটটা একটু ফাঁক করে ভেতরে ঢুকে স্কুলের বিল্ডিংয়ের দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ছোটাচ্চু মাহতাব চাচার ছোট ঘরটার ভেতরে ঢুকে বলল, “আমি আসলে একটা নিউজ করতে চাই।”
“নিউজ?”
“হ্যাঁ। ভূতের ওপরে নিউজ।”
মাহতাব চাচা এইবারে একটু নড়ে চড়ে উঠল। “ভূতের ওপর?”
“হ্যাঁ।” ছোটাচ্চু মুখ গম্ভীর করে বলল, “আমি শুনেছি এই স্কুলটাতে নাকী ভূত আছে। এইটাতো অনেক পুরনো বিল্ডিং, পুরনো বিল্ডিংয়ে সবসময় ভূত থাকে। আপনি যেহেতু এইখানে রাতে থাকেন তাই জানতে চাইছিলাম আপনি কী রাতে কখনো কিছু দেখেছেন? শুনেছেন?”
মাহতাব চাচা বিড় বিড় করে কিছু একটা দোয়া পড়ে বুকে একটু থুতু ফেলল, তারপর গলা থেকে ঝুলে থাকা প্রায় ঢোলের মতো বড় একটা তাবিজকে হাত দিয়ে ধরে বলল, “আপনি ভুল শুনেন নাই। এই স্কুলে তেনাদের ভয় আছে।”
ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “তেনারা কারা? তারা কী করে?”
“তেনাদের নাম রাত্রে নিতে চাই না।”
“কিন্তু কী করে?”
“হাঁটে। সারারাত স্কুলের বারান্দা দিয়া হাঁটে।”
“দেখতে কী রকম?”
মাহতাব চাচা জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “সেইটা কবে কেডা? তারে কাছে থেকে কে দেখতে যাবে? আমার জানের মায়া নাই? কয়দিন থেকে মনে হয় উৎপাত বাড়ছে।”
ছোটাচ্চু ভুরু কুচকালো, জিজ্ঞেস করল, “উৎপাত বেড়েছে?”
“হ্যাঁ।”
“কেমন করে বুঝলেন?”
“গতরাতে স্পষ্ট শুনলাম বাথরুমে ফ্লাশ করল।”
“ভূতে বাথরুমে ফ্লাশ করল? তার মানে ভূত বাথরুম করে? বড়টা নাকি ছোটটা?”
“কবে কেডা।”
মাহতাব চাচা বিরক্ত হয়ে বলল, “আমি কী দেখতে গেছি নাকি? আমার জানের মায়া নাই?”
ছোটাচ্চু যখন মাহতাব চাচার সাথে এরকম একটা আলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। ঠিক তখন টুনি স্কুলের বড় বিল্ডিংয়ের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে চাপা গলায় ডাকে, “রাজু। এই রাজু। তুই কোথায়?”
টুনি একটা একটা ক্লাসঘরের সামনে দিয়ে হাঁটে। আবছা অন্ধকারে দরজার তালা পরীক্ষা করে। কোনো একটা তালা নিশ্চয়ই চিউয়িংগাম দিয়ে নষ্ট করে রেখেছে, সেই ঘরে রাজু আছে। সারাক্ষণ ঘরের ভেতরে বসে থাকবে কে বলেছে? হয়তো অন্ধকারে অন্য কোথাও ঘাপটি মেরে আছে। তাই টুনি হেঁটে যেতে যেতে চাপা গলায় ডাকে, “রাজু। এই রাজু। আমি টুনি। তোর ভয় নাই, বের হয়ে আয়। বের হয়ে আয়। কেউ জানবে না।”