ছোটাচ্চু বলল, “মোটাসোটা বেজার মানুষটার নাম কাজেম আলী?”
জয়ন্ত কাকু হাসল, বলল, “হ্যাঁ। খুব কম কথা বলে কিন্তু কাজেম আলী থেকে কাজের মানুষ দুনিয়াতে এখনো জন্ম হয় নাই। দেখে-শুনে মনে হবে কিছু বুঝেসুঝে না কিন্তু অসম্ভব বুদ্ধিমান। তোদের সব দায়িত্ব ওর হাতে। যেকোনো ক্রাইসিস সামাল দিতে পারবে।”
ছোটাচ্চু বলল, “গুড। ক্রাইসিস হলে আমি তাল খুঁজে পাই না।”
বাচ্চাদের কেউই আগে কখনো প্লেনে উঠে নাই, তাই ছোটাচ্চু সবাইকে লাইনে দাঁড়িয়ে আলাদা আলাদা ভাবে নিজের বোর্ডিং কার্ড নিতে বলল। কেউ স্বীকার করল না কিন্তু সবারই বুক ধুক ধুক করছিল যদি বোর্ডিং কার্ডের মহিলা হঠাৎ করে কাউকে বলে বসে যে তার টিকিটে গোলমাল আছে এবং সে যেতে পারবে না? তাহলে কী হবে? কিন্তু সেরকম কিছু হলো না সবাই একটা বোর্ডিং কার্ড পেয়ে গেল।
এক্স-রে মেশিনে তাদের ব্যাগ চেক করে সবাই ভেতরে ঢুকে গেল। এখন প্লেনের জন্য অপেক্ষা করা। একটু পরে পরে সবাই দেখছে প্লেনটা ঠিক সময়েই ছাড়বে নাকি ছাড়তে দেরি হবে। ভেতরে অপেক্ষা করার জায়গাটাতে অনেক মানুষ–একেকজন একেক জায়গায় যাবে। তবে বাচ্চাদের এই দলটার মতো আর কেউ নেই। বাচ্চারা প্রাণপণ চেষ্টা করছে উত্তেজনাটা দমিয়ে রাখতে কিন্তু কোনোভাবে সেটা সম্ভব হচ্ছে না।
শেষ পর্যন্ত প্লেন ছাড়ার সময় হলো। একটা বাসে সবাইকে তুলে নিয়ে তাদেরকে প্লেনের কাছে নামিয়ে দিল। সিঁড়ি দিয়ে প্লেনের ভেতরে ঢুকে সবাই মুগ্ধ হয়ে যায়। কী সুন্দর সারি সারি সিট, তারা দৌড়াদৌড়ি করে নিজেদের সিটে বসে এবং হঠাৎ করে আবিষ্কার করল শুধু অর্ধেকে জানালার কাছে সিট পেয়েছে। যারা জানালার পাশে সিট পায় নাই হঠাৎ করে তাদের মনে হলো এই জীবন বৃথা। যারা একটু ছোট তারা প্রায় কেঁদেই ফেলত, তখন ছোটাচ্চু সমাধান করে দিল। অর্ধেক সময় একজন জানালার কাছে বসবে, বাকি অর্ধেক সময় অন্যজন।
প্লেনে বসে সিট বেল্ট বেঁধে সবাই অপেক্ষা করতে থাকে। এয়ার হোস্টেস কখন কী করতে হবে সবকিছু বলে দিল। একটু পরেই গর্জন করে প্লেনটা নড়তে থাকে। যখন রানওয়ে দিয়ে প্লেনটা ছুটতে থাকে সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে থাকে, আর কী আশ্চর্য সত্যি সত্যি এত বড় প্লেনটা দেখতে দেখতে আকাশে উঠে গেল। যারা একটু বড় হয়ে গেছে তার মুখটা গম্ভীর করে রাখার চেষ্টা করল, কিন্তু যারা ছোট তারা আনন্দে চিৎকার করে উঠে।
প্লেনের জানালা দিয়ে সবাই নিচে তাকিয়ে থাকে, প্রথমে শহরের দালান কোঠা, তারপর গ্রাম, নদী এক সময় সমুদ্র। একেবারে ঘড়ি ধরে মাঝামাঝি সময়ে জানালার পাশে যারা বসেছে তাদের সাথে সিট বদল করা হলো। শান্ত একটু গাই-গুই করছিল, ছোটাচ্চু তখন ধমক দিয়ে তার সিট বদল করাল।
দেখতে দেখতে তারা কক্সবাজার পৌঁছে যায়। এত তাড়াতাড়ি তাদের প্লেনের ভ্রমণ শেষ হয়ে যাবে কেউ আশা করে নাই। কক্সবাজার পৌঁছানোর পর যখন প্লেন থেকে নামার সময় হলো তারা অবাক হয়ে দেখল জয়ন্ত কাকু তাদের দেখভাল করার জন্য কাজেম আলী নামে যে মোটাসোটা বেজার মানুষটিকে দিয়েছেন সে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। প্লেনে জানালার কাছে সিট পেয়েও একজন
পুরো সময়টা নাক ডেকে ঘুমাতে পারে সেটা তাদের বিশ্বাসই হতে চায় না!
কাজেম আলী হঠাৎ ধড়মড় করে ঘুম থেকে উঠল। নিজের ছোট একটা ব্যাগ নিয়ে সে সবার সাথে নামল। যেহেতু কারোই আলাদা লাগেজ নাই তাই তারা কাজেম আলী নামের মানুষটার পিছু পিছু এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে এলো। বাইরে তাদের নেওয়ার জন্যে হোটেলের বিশাল একটা গাড়ি অপেক্ষা করছে। তারা ওঠামাত্র সেটা ছুটে যেতে থাকে, খানিকদূর যেতেই তারা হঠাৎ করে দেখে সামনে সমুদ্র। কী আশ্চর্য ব্যাপার! মনে হচ্ছে একেবারে আকাশ থেকে বুঝি সমুদ্রটা নিচে নেমে আসছে।
এই বাচ্চাদের নিয়ে আগে যেটা কখনো ঘটেনি হঠাৎ করে সেটা ঘটে গেল, হঠাৎ করে সবাই চুপ হয়ে গেল। সমুদ্রের নিশ্চয়ই কোনো এক ধরনের ম্যাজিক আছে কারণ সবাই চুপ করে অবাক হয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইল। প্রথমবার সমুদ্র দেখলে সবাই কেন যে অবাক হয়ে যায়! এত বড় সমুদ্র? কোনো শুরু নেই, শেষ নেই যতদূর তাকানো যায় শুধু পানি আর পানি? সেই পানিতে একটার পর একটা ঢেউ সাদা ফেনা তুলে তীরে এসে লুটিয়ে পড়ছে।
হোটেলে পৌঁছানোর পর কাজেম আলী নামের মোটাসোটা মানুষটা রিসেপশান ডেস্কে কিছু কাগজপত্র সাইন করে অনেকগুলো প্লাস্টিকের কার্ড নিয়ে এলো। এগুলোই নাকি হোটেল রুমের চাবি। কী আশ্চর্য!
লিফটে করে সবাই ছয় তলায় উঠে যায় সেখানে সারি ধরে অনেকগুলো রুম তাদের। তাদের সাথে হোটেলের একজন মানুষ এসেছে সে কীভাবে প্লাস্টিকের কার্ড দিয়ে রুমের তালা খুলতে হয় শিখিয়ে দিল।
হোটেল রুমের ভেতর ঢুকে বাচ্চারা আবার আনন্দে চিৎকার করে ওঠে। বিশাল কাঁচের জানালা, সেই জানালা দিয়ে সমুদ্র দেখা যায়। তারা ছোটাচ্চুটি করে জানালার কাঁচ খুলে ফেলল, সাথে সমুদ্রের লোনা বাতাস হু হু করে রুমের ভেতরে ঢুকে যায়, তার সাথে সমুদ্রের গর্জন! মনে হচ্ছে সমুদ্রটা কাঁদছে। কী আশ্চর্য!
কোন রুমে কে থাকবে সেটা নিয়ে আবার ঝগড়াঝাটি শুরু হয়ে যাচ্ছিল কিন্তু ছোটাচ্চু সেটা হতে দিল না। মোটামুটি ধমক দিয়ে রুম ভাগ করে দিল, প্রতিটা রুমে দুজনের জন্য দুটি বিছানা। একজন বড় এবং একজন ছোট। শাহানার সাথে মুনিয়া। টুনির সাথে টুম্পা। ছোটাচ্চুর সাথে শান্ত।