টুনি সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “এই যে আন্টি আর আংকেল। আমাদের ক্লাসের যে ফার্স্টবয় রাজু, তার আম্মু আর আব্বু। আমার সাথে একটু কথা বলতে এসেছেন।”
বাচ্চারা সব কিছু বুঝে ফেলার মতো ভঙ্গি করে মাথা নাড়ল। শান্ত বলল, “ফার্স্টবয়! উরে বাপরে বাপ।”
টুনি বলল, “আমি আন্টির সাথে আর আংকেলের সাথে একা একা কথা বলব, তোমরা সবাই যাও।”
কেউ চলে যাবার নিশানা দেখাল না। তখন ছোটাচ্চু সবাইকে ঠেলে বের করে দিতে থাকে। ছোট-বড় সবাই বের হয়ে যাবার পর টুনি জিজ্ঞেস করল, “আমাকে একটু বলবেন রাজু কখন বাসা থেকে চলে গেছে।”
“পরশু দিন স্কুলে গেছে, তারপর আর বাসায় আসে নাই।”
“রাজু কী যাওয়ার আগে আপনাদের কোনো চিঠি লিখে গেছে।”
রাজুর আম্মু আর আন্ধু একজন আরেকজনের দিকে তাকালেন, তারপর দুজনের অস্বস্তিতে নড়ে-চড়ে বসলেন। রাজুর আম্মু নিচের দিকে তাকিয়ে রইলেন, আব্বু একটু গলা পরিষ্কার করে বললেন, “ইয়ে মানে একটা চিঠির মতো কিছু একটা লিখে গেছে। তার ঘরে পড়ার টেবিলের ওপর ছিল।”
“কী লিখেছে চিঠিতে?”
রাজুর আব্বু আবার একটু কাশলেন, তারপর মাথা চুলকালেন তারপর বললেন, “লিখেছে মানে যেন মানে আমরা যেন ইয়ে–” কথা শেষ না করে রাজুর আব্বু থেমে গেলেন।
টুনি বুঝতে পারল, চিঠিটায় কী লিখেছে বলতে লজ্জা পাচ্ছেন। টুনি তাই জিজ্ঞেস করল, “চিঠিটা সাথে আছে?”
রাজুর আব্বু আবার রাজুর আম্মুর দিকে তাকালেন তারপর রাজুর আম্মু তার ব্যাগ খুলে একটা চিঠি বের করে টুনির হাতে দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
ছোট চিঠি। চিঠিতে লেখা :
প্রিয় আব্বু আর আম্মু :
আমি বাসা থেকে চলে যাচ্ছি। আমাকে খোঁজার চেষ্টা করে লাভ নেই, আমাকে তোমরা খুঁজে পাবে না। খুব ইচ্ছা করছে। কোনো একটা জায়গায় শান্তিতে কয়েকদিন থাকি যেখানে তোমরা দুজন দিন-রাত ঝগড়া করছ না। মাঝে মাঝে মনে হয় পাগল হয়ে যাব। তোমরা এরকম কেন? আমার জন্য অস্থির হয়ো না, নিজে থেকেই কোনো একদিন চলে আসব।
রাজু।
টুনি চিঠিটা ফেরত দিয়ে বলল, “আমিও তাই ভাবছিলাম।”
টুনির আম্মু জিজ্ঞেস করলেন “কী ভাবছিলে?”
“যে এইরকম কিছু একটা করে ফেলবে।”
“তোমার সাথে এইটা নিয়ে কথা বলেছে?”
“সরাসরি বলে নাই, কিন্তু তার কথা থেকে আন্দাজ করেছি।”
রাজুর আম্মু খপ করে টুনির হাত ধরে ফেললেন। ভাঙা গলায় বললেন, “আমার ছেলেটাকে বের করে দাও মা, প্লিজ। কোথায় আছে একা একা–”
টুনি বলল, “আন্টি, আংকেল, আপনারা এখন বাসায় যান। আমি দেখি। খুঁজে বের করে আপনাদের জানাব।”
এরকম সময় দরজা ঠেলে ঝুমু খালা একটা ট্রেতে চা-নাশতা নিয়ে ঢুকল। টেবিলে রেখে বলল, “একটু চা-নাশতা খান। আপনাদের দেখে মনে হয় কয়দিন কিছু খান নাই।”
“ছেলেটা হারিয়ে গেছে, খাব কেমন করে?”
“হারায়ে যায় নাই, পালায়ে গেছে। আপনাগো চিন্তার কারণ নাই, টুনি খুঁজে বের করে ফেলবে। টুনির মগজের মাঝে খালি ব্রেন।”
“ঝুমু খালা, মগজের ইংরেজি হচ্ছে ব্রেন।
ঝুমু খালা ধমক দিয়ে বলল, “সব কথার মাঝে তোমার একটা কথা বলার স্বভাব।”
ধমক খেয়ে টুনি চুপ করে গেল। কুমু খালা এবারে রাজুর আম্মুকে উপদেশ দিতে শুরু করল, “আফা, আপনাদের একটা কথা বলি। বাচ্চা জন্ম দিলেই কিন্তু দায়িত্ব শেষ না। বাচ্চারে ঠিক করে মানুষ করতে হয়। বাচ্চারে আদর করতে হয়। বাচ্চার সামনে যদি ঝগড়াঝাটি করেন–”
টুনি ঝুমু খালাকে থামানোর চেষ্টা করল, বলল, “ঝুমু খালা–”
ঝুমু খালা টুনিকে উল্টো একটা ধমক দিল, “আমি একটা কথা বলতেছি তুমি মাঝখানে ডিস্টার্ব দাও কেন?” তারপর ঘুরে রাজুর আম্মুর দিকে তাকিয়ে বলল, “বাচ্চার সামনে ঝগড়াঝাটি করতে হয় না। বাচ্চার সামনে ঝগড়াঝাটি করলে বাচ্চা অমানুষ হয়ে যায়। আমাগো গ্রামে স্বামী-স্ত্রী বাচ্চার সামনে ঝগড়া করত, সেই বাচ্চা বড় হয়ে ডাবল মার্ডারের আসামি।”
টুনি এবারে রীতিমতো গলা উঁচিয়ে বলল, “ঝুমু খালা, আন্টি আর আংকেল এখন খুব টায়ার্ড। তারা বাসায় গিয়ে রেস্ট নেবেন। তার আগে আমার সাথে একটু কথা বলবেন।”
ঝুমু খালা চলে যাবার পর টুনি বলল, “আন্টি, আংকেল আপনারা কিছু মনে করবেন না। ঝুমু খালা সব সময় সবার সাথে এইভাবে কথা বলে।”
রাজুর আম্মু বললেন, “কিন্তু কথাটা তো ভুল বলে নাই। আসলেই আমরা তো রাজুর সামনেই ঝগড়াঝাটি করি। বুঝতে পারি নাই রাজুকে এইভাবে এফেক্ট করবে—”
টুনি বলল, “জী রাজুও বলেছে আমাকে। এত ভালো স্টুডেন্ট কিন্তু লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে। খুব মন খারাপ করে থাকে।”
রাজুর আব্বু রাজুর আম্মুর দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে বললেন, “আমি একশবার বলেছি ছেলেটার দিকে তাকাও, কিন্তু তোমার সময় নাই।”
রাজুর আম্মু দাঁতের ফাঁক দিয়ে হিস হিস শব্দ করে বললেন, “কেন? আমাকেই কেন সব দেখতে হবে? তোমার কোনো দায়-দায়িত্ব নাই?”
রাজুর আব্বু হতাশ হবার ভঙ্গি করে বললেন, “এই যে, এই যে আবার শুরু করে দিলে।”
“আমি? আমি শুরু করেছি?”
টুনি অবাক হয়ে দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে, এরকম অবস্থাতেও টুনির সামনে যদি দুজন ঝগড়া শুরু করে দেয় তাহলে বাসাতে নিশ্চয়ই দুজনে খুনোখুনি করে ফেলে। টুনির হঠাৎ করে রাজুর জন্য মায়া হতে থাকে।
রাজুর আব্বু-আম্মু সত্যি সত্যি ঝগড়া শুরু করে দেয়ার আগে টুনি তাদের থামানোর চেষ্টা করল। বলল, “আংকেল, আন্টি, আপনারা নিশ্চয়ই খুব টায়ার্ড। আপনারা একটু খেয়ে নেন, তারপর বাসায় গিয়ে রেস্ট নেন। আমি রাজুকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করি।”