“একটা জিনিস নষ্ট করা সবসময় সোজা। ঠিক করা হচ্ছে কঠিন।”
রাজু মাথা নাড়ল, বলল, “তোর মাথায় আসলেই অনেক বুদ্ধি।”
টুনি হাসল, বলল, “এইগুলো আসল বুদ্ধি না। এইগুলো হচ্ছে দুষ্টু বুদ্ধি।”
“তোর মাথায় নিশ্চয়ই ভালো বুদ্ধিও আছে। দেখি পরীক্ষা করে।”
“কীভাবে পরীক্ষা করবি?”
“মনে কর একজন বেশ কয়েকদিনের জন্য এডভেঞ্চারে যাবে, যেখানে কোনো খাওয়া-দাওয়া পাওয়া যায় না। তাহলে তার সাথে কী নিয়ে যেতে হবে যেন না খেয়ে থাকতে হয় না।”
টুনি উত্তর না দিয়ে চশমার ভেতর দিয়ে সরু চোখে রাজুর দিকে তাকাল, বলল, “তুই বাড়ি থেকে পালাবি?”
রাজু জোরে জোরে মাথা নাড়ল, বলল, “না, না, না–”
“তাহলে–?”
“এমনিই জিজ্ঞেস করছি। এমনি”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “এমনি কেউ এগুলো জিজ্ঞেস করে না। সত্যি করে বল, তুই বাড়ি থেকে পালাবি?”
“না। আমি বাড়ি থেকে পালাব না।” “তাহলে কেন এটা জিজ্ঞেস করছিস?”
“তোর বুদ্ধি টেস্ট করার জন্য। ঠিক আছে তোর বলতে না চাইলে বলতে হবে না।”
“এটা বুদ্ধি টেস্ট করার কিছু না। এর মাঝে কোনো বুদ্ধি নাই। এটা জানার বিষয়।”
“ঠিক আছে।” রাজু মেনে নিল। বলল, “তুই জানলেও তোর বলতে হবে না।”
“আমি খুব বেশি জানি না, কিন্তু দাদির কাছে শুনেছি সেভেন্টি ওয়ানে সবাই যখন বাড়িঘর ছেড়ে পালাচ্ছিল তখন সাথে নিত চিড়া।”
“চিড়া?”
“হ্যাঁ। শুধু চিড়া। খিদে লাগলে চিবিয়ে একটু খেয়ে নিলেই পেট ভরে যেত। এজন্যে বলে শুকনো চিড়া পেট ভরে খেতে নেই। এটা নাকি পেটে গিয়ে ফুলে যায়।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ, চিড়া শুকনা, নষ্ট হতো না। দিনের পর দিন রাখা যেত।”
“ইন্টারেস্টিং।”
“আজকাল অবশ্যি আরো অনেক কিছু বের হয়েছে। হাই প্রোটিন বিস্কুট। প্যাকেট দুধ। হাই এনার্জি ড্রিংক।”
“চিড়াই ভালো। একেবারে সহজ সরল।”
টুনি আবার চশমার ভেতর দিয়ে সরু চোখে তাকাল, বলল, “দেখ, রাজু, খবরদার তুই বাসা থেকে পালানোর চেষ্টা করবি না। রাস্তা-ঘাট কিন্তু খুব ডেঞ্জারাস। ভয়ানক কোনো বিপদে পড়ে যাবি।”
রাজু মুখ শক্ত করে বলল, “আমি নিজেকে কোনো বিপদে ফেলব না।”
“খোদার কসম?”
“আমি এই সব কিরা-কসমে বিশ্বাস করি না। কিন্তু তুই যদি সত্যি শুনতে চাস তাহলে বলব।”
“বল।”
“খোদার কসম। আমি নিজেকে কোনো বিপদে ফেলব না।”
টুনি সরু চোখে রাজুর দিকে তাকিয়ে রইল।
.
একদিন সরকারি ছুটি, একদিন স্কুল ছুটি তার সাথে শুক্র-শনিবার মিলে পরপর চারদিন স্কুল ছুটি। যখনই এরকম কয়েকদিনের ছুটি পাওয়া যায় তখন সেই ছুটিতে কোথায় যাওয়া হবে কী করা হবে সেটা নিয়ে নানারকম আলোচনা হয় কিন্তু বেশির ভাগ সময়েই শেষ পর্যন্ত কিছু হয় না। এবারে যেরকম সবাই মিলে চিড়িয়াখানায় যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু শেষ মুহূর্তে শান্ত খবর আনল চিড়িয়াখানায় নতুন এক ধরনের বানর আনা হয়েছে। সেগুলোকে বিশেষ ধরনের শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করানোর কথা, কিন্তু সেই শ্যাম্পু পাওয়া যাচ্ছে না বলে বানরকে গোসল করানো যাচ্ছে না এবং সেই কারণে পুরো চিড়িয়াখানায় বিকট দুর্গন্ধ। এই বর্ণনা শুনে অনেকেই পিছিয়ে গেল বলে শেষ পর্যন্ত চিড়িয়াখানায় যাওয়া হলো না। তারপর ঠিক করা হলো সবাই মিলে নাটক দেখতে যাবে। কোন নাটক দেখা হবে সেটা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক শুরু হওয়ায় সেটাও শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়ে গেল। তখন ঠিক করা হলো শপিং মলে গিয়ে আইসক্রিম খাওয়া হবে। সেজেগুঁজে যখন সবাই বের হবে তখন টুম্পা হড় হড় করে বমি করতে লাগল। আইসক্রিম খাওয়াতে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ টুম্পার, কাজেই তাকে ছাড়া তো আর যাওয়া যায় না কাজেই এই প্রোগ্রামটাও বাতিল করতে হলো এবং সে কারণে সবাই কয়েকদিন থেকে বাসায়।
ছুটির তৃতীয় দিন রাত্রি বেলা বাসায় দুজন গেস্ট এলেন। তারা স্বামী-স্ত্রী, চেহারা দেখেই মনে হয় তাদের ওপর দিয়ে বিশাল ঝড় বয়ে গিয়েছে। কেউ বলে দেয় নাই তারপরেও দরজা খুলেই টুনি বুঝতে পারল এরা হচ্ছেন রাজুর বাবা-মা এবং রাজু তার কথা রাখে নাই, সে বাসা থেকে পালিয়েছে।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলা টুনিকে দেখে প্রায় চিৎকার করে বললেন, “মা, তুমি নিশ্চয়ই টুনি। আমার রাজু কোথায় তুমি জান?”
অন্য যে কেউ হলে তার পুরো বিষয়টা বুঝতে অনেক সময় লাগত, টুনির কথা আলাদা তার বুঝতে এক সেকেন্ড দেরি হলো না। রাজু বাসা থেকে পালিয়েছে, রাজুর বাবা-মা তার স্কুলের ছেলেমেয়ে আর টিচারদের কাছে খোঁজখবর নিয়েছে। গত কিছুদিন থেকে রাজু টুনির সাথে নিরিবিলি কথাবার্তা বলেছে সেটা নিশ্চয়ই অনেকে লক্ষ করেছে। তারা টুনির নাম বলেছে তাই বাবা মা টুনির কাছে চলে এসেছেন।
টুনি কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই মা হাঁটু গেড়ে বসে টুনিকে দুই হাতে ধরে ফেললেন তারপর প্রায় একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, “মা, তুমি জান আমার রাজু কোথায়? জান?”
“না। জানি না। কিন্তু–কিন্তু—”
“কিন্তু কী?”
“আমি আন্দাজ করতে পারি”
মা প্রায় চিৎকার করে বললেন, “তাহলে আন্দাজ করো। বল।”
টুনি রাজুর আম্মুর হাত ধরে টেনে তুলে দাঁড় করিয়ে সোফায় বসিয়ে দিয়ে বলল, “আপনি আগে একটু শান্ত হয়ে বসেন। আমাকে একটু চিন্তা করতে হবে।”
বসার ঘরে হই-চইয়ের শব্দে বাসার প্রায় সবাই চলে এসেছে। সবার সামনে ঝুমু খালা তার কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বোঝা যাচ্ছে যেকোনো মুহূর্তে সে তার বক্তৃতা শুরু করে দেবে। ছোটদের অনেকেই বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে, তারা একজন আরেকজনকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে জানার চেষ্টা করছে কী হচ্ছে। বড়দেরও অনেকে এসেছে, ছোটাচ্চু বাচ্চাদের শান্ত করার চেষ্টা করল, ধমক দিয়ে বলল, “তোরা চুপ করবি? শুনি কী হয়েছে।”