“কী?”
“যদি ছোট বাচ্চা-কাচ্চা থাকে তাহলে এই বাচ্চাগুলো মনে করে দোষটা তাদের। তারা কিছু একটা ভুল করেছে সেই জন্যে বাবা-মা আলাদা হয়ে গেছে।”
“তাহলে রাজুর কিছু করার নাই?”
“আমি তো কিছু চিন্তা করে পাই না। তুই তার ভালো বন্ধু হয়ে থাকিস যেন তোর কাছে এসে দুঃখের কথাগুলো বলতে পারে। কাউকে দুঃখের কথা বললে মনটা হালকা হয়—”
.
কাজেই টুনি রাজুর ভালো বন্ধু হওয়ার জন্য চেষ্টা করে গেল। দেখা হলেই মুখ হাসি হাসি করে জিজ্ঞেস করে, “রাজু, তোর খবর কী?”
রাজু বেশির ভাগ সময় উত্তর দেয়, “নূতন কোনো খবর নাই।”
“লেখাপড়া শুরু করেছিস।”
“নাহ্।”
“শুরু করে দে, না হলে আমরা বিপদে পড়ব।”
“তোমাদের কী বিপদ?”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “উঁহু উঁহু হলো না।”
“কী হলো না।”
“তোমাদের বলা যাবে না। ঠিক করে বল।”
“ও আচ্ছা।”
রাজু তখন ঠিক করে বলে, “তোদের আবার কী বিপদ?”
“স্যার ম্যাডাম যখন ক্লাসে কিছু জিজ্ঞেস করে তখন কেউ উত্তর দিতে না পারলে কেমন রেগে যায় দেখিস না। তুই উত্তর দিয়ে আমাদের বিপদ কাটিয়ে দিবি।”
রাজু হাসার ভঙ্গি করে বলে, “ও আচ্ছা।”
টুনি আরো কিছুক্ষণ এটা-সেটা নিয়ে কথা বলে, নিজ থেকে তার আব্বু আম্মুর কথা জিজ্ঞেস করে না। রাজুও কিছু বলে না। টুনি অবশ্যি রাজুকে চোখে চোখে রাখে। তাদের ক্লাস একতলায় কিন্তু রাজুকে প্রায়ই দেখা যায় দুই-তিন তলায় ঘোরাঘুরি করে। ছুটির ঘণ্টা পড়ার পর সবাই চিৎকার করে ক্লাস থেকে বের হয়ে যায় শুধু রাজুকে দেখা যায় গালে হাত দিয়ে বসে আছে যেন বাসায় যাবার কোনো তাড়া নেই।
একদিন রাজু এসে টুনিকে জিজ্ঞেস করল, “টুনি তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
“উঁহু। হলো না হলো না।”
রাজুর তখন মনে পড়ে, সে একটু হেসে জিজ্ঞেস করে, “তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
“কী কথা?”
“ভূত বলে কী কিছু আছে?”
টুনি চোখ কপালে তুলে বলল, “ভূত?”
“হ্যাঁ।”
“তোর ভূত নিয়ে মাথা ব্যথা কিসের জন্যে? ভূত থাকবে কোথা থেকে?”
রাজু মাথা নাড়ল, বলল, “আমারও তাই মনে হয়, ভূত নাই। কিন্তু মাহতাব চাচা এমনভাবে বলে যে মনে হয় ভূত আছে।”
মাহতাব চাচা তাদের স্কুলের গার্ড, তার সাথে রাজুর ভূত নিয়ে আলোচনা কেন হচ্ছে টুনি বুঝতে পারে না। টুনি ভুরু কুচকে জিজ্ঞেস করল, “তুই মাহতাব চাচার সাথে জিন-ভূত নিয়ে আলাপ করছিস, ব্যাপারটা কী?”
রাজু কেমন যেন একটু লজ্জা পেল। আমতা আমতা করে বলল, “না, মানে এইতো–”
টুনি জিজ্ঞেস করল, মাহতাব চাচা ভূত নিয়ে ঠিক কী বলেছে? কোথায় ভূত দেখেছে?”
“এইতো আমাদের স্কুলে। রাত্রে বেলা এইখানে নাকি ভূত দেখা যায়।”
“সত্যি?” টুনি চোখ বড় বড় করে বলল, “কী রকম ভূত?”
রাজু বলল, “ছায়ার মতন। বারান্দা দিয়ে হাঁটে। জানালা খুলে বন্ধ করে।”
টুনি বলল, “কী মজা। একটা যদি কোনোমতে ধরে ফেলতে পারি চিন্তা করতে পারিস কী মজা হবে? শিশিতে ভরে পকেটে করে বাসায় নিয়ে যেতাম। পড়ার টেবিলে সাজিয়ে রাখতাম।”
রাজু বলল, “ভূত শিশিতে আটবে?”
“আটবে না কেন। চিপে চুপে ঢুকিয়ে ফেলব।”
টুনি একটা ভূতকে চিপে চুপে একটা শিশিতে ঢুকিয়ে দিচ্ছে দৃশ্যটা চিন্তা করে রাজু একটু হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল, “তাহলে তুই ভূত বিশ্বাস করিস না?”
“ভূতের গল্প বিশ্বাস করি। ভূতে করি না।”
“তোকে যদি কেউ বলে এই স্কুলে রাত্রের বেলা একা একা থাকতে হবে তাহলে থাকতে পারবি?”
“কেউ যদি বাজি ধরে তাহলে চেষ্টা করতে পারি, তা না হলে কেন খামোখা রাত্রে এই স্কুলে থেকে মশার কামড় খাব? দিনের বেলাতেই এইখানে থাকতে অসহ্য লাগে, আবার রাত্রে?”
রাজু মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিকই বলেছিস। স্কুলে অসহ্য লাগে।”
.
কয়দিন পর টুনি দুপুর বেলা বারান্দায় বসে অন্যদের ছোটাচ্চুটি করে খেলতে দেখছে তখন রাজু এসে তার পাশে বসল। বলল, “চৌবাচ্চার অঙ্কটা করেছি।”
টুনি খুশি হয়ে বলল, “করেছিস? গুড। আমাকে দেখিয়ে দিস কীভাবে করতে হবে। আমি বুঝি না কেন একটা অঙ্ক এরকম প্যাচিয়ে দিতে হবে। সোজাসুজি দিতে সমস্যা কী?”
“সোজাসুজি দিলে সেইটা হিসাব। যোগ-বিয়োগ আর গুণ-ভাগ। প্যাচিয়ে দিলে সেইটা অঙ্ক।” রাজু টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “কিন্তু তোর মাথায় তো অনেক বুদ্ধি তুই অঙ্ক করতে চাস না কেন?”
টুনি দেখল আজকাল রাজুকে আর তুই করে বলার কথা মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে না নিজেই তুই করে বলছে। টুনি বলল, “আসলে বুদ্ধি নাই সেজন্যে।”
রাজু মাথা নাড়ল, বলল, “আসলে তুই বুদ্ধিটা এখানে সেখানে খরচ করতে চাস না। আসল বুদ্ধির জায়গায় খরচ করতে চাস, তাই না?
টুনি হাসল, বলল, “আসল বুদ্ধির জায়গা কোনটা?”
“যেমন মনে কর–” রাজু মুখটা সুচালো করে কিছু একটা চিন্তা করল, তারপর বলল, “মনে কর একটা তালাকে এমন কিছু করতে চাই যেন সেইটা আর কাজ না করে–তাহলে কী করতে হবে?”
“কাজ না করে মানে কী? তালা বন্ধ হবে না, নাকি তালা খুলবে না?”
“তালা বন্ধ হবে না।”
“কেন?”
রাজু উত্তর দিল না, ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলল, “এমনি।”
টুনি বলল, “সবচেয়ে সোজা হচ্ছে চিউয়িংগাম খেয়ে সেইটা তালার গর্তে ঠেলে ভর্তি করে রাখা–তাহলে আর বন্ধ করতে পারবে না।”
রাজু অবাক হয়ে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর একটু হেসে বলল, “এত সোজা।”