“আমি তোকে তুই করে বলছি আর তুই আমাকে তুমি করে বলছিস!”
রাজু একটু লজ্জা পেয়ে বলল, “আমি কাউকে তুই করে বলতে পারি না।”
“চেষ্টা করে দেখ। খুবই সোজা।”
“কীভাবে চেষ্টা করব?”
টুনি বলল, “তুই আমাকে বল, তুই একটা গাধা।”
“তোমাকে গাধা বলব?”
“হ্যাঁ।”
“কিন্তু তুমি তো গাধা না।”
“এত প্যাচালে হবে না। বলে ফেলতে হবে। তাহলে এভাবে বল, “চৌবাচ্চার এই সোজা অঙ্কটাও পারিস না? তুই একটা গাধা।”
রাজু মুখটা হাসি হাসি করে টুনির দিকে তাকাল, তারপর বলল, “চৌবাচ্চার এই সোজা অঙ্কটাও পারিস না? তুই একটা গাধা।”
টুনি বলল, “গুড! দেখলি কত সোজা। এবারে আরেকটা কিছু বল।”
“বলব?”
“হ্যাঁ।”
রাজু বলল, “তুই প্লিজ আমার কথা ক্লাসে আর কাউকে বলিস না তাহলে আমার খুব লজ্জা লাগবে।”
টুনি বলল, “মাথা খারাপ? আমি ক্লাসে কাউকে বলব না।”
.
টুনি ক্লাসে কাউকে বলল না কিন্তু বাসায় গিয়ে ব্যাপারটা অনেকের সাথে আলোচনা করল। যেকোনো বড় সমস্যা হলে প্রথমেই ঝুমু খালার সাথে আলাপ করে, এবারেও তাই করল। তাকে সবকিছু খুলে বলার পর জানতে চাইল, এখন কী করা উচিত।
।ঝুমু খালার উত্তর দিতে এক সেকেন্ড দেরি হলো না। চোখে-মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, “জরিনি বেওয়ার পান পড়া। একটা পান পড়া খেলেই স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মিল-মহব্বত ফিরে আসবে। আমাদের গ্রামে কাজেম আলী মোল্লার ছিল দুই বউ। বড় বউ একদিন—”
টুনি ঝুমু খালাকে কথার মাঝখানে থামিয়ে বলল, “ঝুমু খালা, তোমার মনে নাই আমি তোমাদের গ্রামে গিয়েছি? জরিনি বেওয়ার সাথে কথা বলেছি? জরিনি বেওয়া নিজে আমাকে বলেছে তাবিজ-কবজ-পান পড়া বলে কিছু নাই”
ঝুমু খালা মোটেও দমে গেল না। হাত পা নেড়ে বলল, “তোমার মতো ছোট মেয়েরে আর কী বলবে? জরিনি বেওয়ার যে পোষা জীন আছে সেইটা কী তোমারে বলছে? বলে নাই। সত্যি কথা বললে তোমাগো দাঁত কপাটি লাগব না?”
টুনি বলল, “তাবিজ-কবজ-পান পড়ার কথা ভুলে যাও। অন্য কিছু করা যায় কী না বল।”
“এই হলো তোমাগো সমস্যা। চাইর পাতা বই পড়ে মনে করে দুনিয়ার সবকিছু জেনে গেছে। সবকিছু অবিশ্বাস কর। তাবিজ-কবজ মানতে চাও না।”
টুনি ধৈর্য ধরে ঝুমু খালার বক্তৃতা শুনল, বক্তৃতা শেষে ঝুমু খালা আরেকটা সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করল, বলল, “নতুন যে হিন্দি সিরিয়ালটা শুরু হইছে জিগি জিগি পেয়ার সেইখানে এইরকম একটা ঘটনা আছে। নায়িকার ব্লাড ক্যান্সার। হাসপাতালে নিছে–”
টুনি বুঝতে পারল ঝুমু খালাকে দিয়ে হবে না। তখন সে গেল ছোটাচ্চুর কাছে। সবকিছু শুনে ছোটাচ্চু বলল, “দুইজন যখন কমিটমেন্ট করে তখন যদি পারস্পরিক সম্মানবোধ না থাকে তাহলে সেটা হচ্ছে প্রেসক্রিপশনার ফর ডিসাস্টার। আমি তো বুঝতেই পারি না একজন বড় মানুষ ঝগড়া করে কেমন করে?”
টুনি নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “তুমি বুঝতে পার না? মনে আছে যখন তুমি আর ফারিহাপু ঝগড়া করে কথাবার্তা বন্ধ করে দিলে? আমরা যদি তখন–”
ছোটাচ্চু লজ্জা পেয়ে বলল, “আরে সেটা তো ছিল খুবই হাস্যকর একটা ব্যাপার–”
“মোটেও হাস্যকর ছিল না। এখন তুমি বল আমি আমাদের ক্লাসের ছেলেটাকে কী করতে বলব?”
ছোটাচ্চু মাথা চুলকাল, বলল, “হলিউডের একটা সিনেমা দেখেছিলাম, সেখানে একটা মেয়ে তার বাবা আর মায়ের মাঝে মিল করে দিয়েছিল।
“কীভাবে?”
“অনেক জটিল কাহিনি এখন ভুলে গেছি।”
টুনি বুঝল ছোটাচ্চুর সাথে কথা বলে লাভ নাই। ছোটাচ্চু এখনো বিয়েও করে নাই। আগে বিয়ে করুক তারপর বউয়ের সাথে ঝগড়া করুক তারপর দেখা যাবে।
তখন টুনি তার দাদির (কিংবা নানির) সাথে কথা বলল। সবকিছু শুনে দাদি জিব দিয়ে চুক চুক শব্দ করে বললেন, “আহারে! এই টুকুন বাচ্চা ছেলের মনে কী কষ্ট। যদি স্বামী-স্ত্রী এইভাবে বাচ্চার সামনে ঝগড়া করে তাহলে তো মুশকিল। ডিভোর্স না হয়ে যায়। ডিভোর্স হলে বাচ্চাটার কী হবে?”
দাদি অনেকক্ষণ আহা উঁহু করলেন, তারপর বললেন, “চেষ্টা করে দেখ মা’টাকে আমাদের বাসায় আনা যায় নাকি। আমি তাহলে মাথায় হাত বুলিয়ে একটু বুঝিয়ে দেখি।”
টুনি বুঝতে পারল দাদির বুদ্ধিটাও কাজ করবে না। রাজুর মা’কে সে কেমন করে বাসায় আনবে? আর সমস্যা কী শুধু তার মায়ের? তার বাবারও নিশ্চয়ই সমস্যা আছে।
তখন টুনি তার আম্মুর সাথে কথা বলল। আম্মু বেশ অবাক হয়ে টুনির কথা শুনলেন। তার ছোট মেয়েটার যে বড় মানুষদের সমস্যা নিয়েও মাথা ঘামাতে হচ্ছে সেটা দেখে আম্মু খুব অবাক হলেন না। জন্মের পর থেকেই দেখে আসছেন মেয়েটা একটু অন্যরকম।
টুনির কথা শেষ হবার পর আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, “ঠিক আছে আমি সবকিছু শুনলাম। এখন?”
“এখন তুমি বল রাজু কী করবে?”
“তোর কী ধারণা রাজুর কিছু একটা করার আছে যেটা করলে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে?”
টুনি মাথা চুলকালো, বলল, “না, মানে–”
“দোষটা কী রাজুর? সে কি কিছু একটা দোষ করেছে যে জন্যে তার আব্বু আম্মু এরকম হয়ে গেছে?”
“না। তা নয়।”
“তাহলে ছেলেটা কী করবে? কিছু যদি করতে হয় তাহলে সেটা করবে তার বাবা-মা। ছেলেটার সামনে ঝগড়াঝাটি করা বন্ধ করবে।”
টুনি আবার মাথা চুলকাল। আম্মু একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “দেখ, হাজব্যান্ড আর ওয়াইফের মাঝে মিলমিশ না হওয়াটা এমন কিছু অস্বাভাবিক না। সেজন্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়-আমেরিকার অর্ধেক বিয়ে ডিভোর্স হয়ে যায়। আমাদের দেশে আগে মেয়েরা সহ্য করত সেইজন্যে বিয়ে ভাঙতো না, আজকাল এতো সহ্য করে না। ডিভোর্স হয়ে যায়। এখন এদেশেও ডিভোর্স হলে সমস্যাটা কী হয় জানিস?”