রাজু কিছু না বলে আবার তার হাতের তালুর দিকে তাকাল তারপর আবার উপরের দিকে তাকাল, তারপর তাকিয়েই রইল।
টুনি নরম গলায় বলল, “তুই আয়। আমার কাছে বস। আমাকে বল কী হয়েছে।”
রাজু পাশে বসবে টুনি আশা করেনি, কিন্তু তাকে অবাক করে রাজু তার পাশে বসল। তারপর প্রায় এক শ কিলোমিটার লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে হাতের তালুর দিকে তাকাল।
টুনি গলার স্বর আরো নরম করে বলল, “বল আমাকে। কী হয়েছে?”
রাজু মুখ তুলে টুনির দিকে তাকাল তারপর বলল, “তার আগে তুমি বল, তোমার আব্বু আর আম্মু কী ঝগড়া করে?”
টুনি এক মুহূর্তে অনেক কিছু বুঝে গেল। সে যে রাজুর সাথে তুই করে বলছে আর রাজু যে ক্লাসে কারো সাথেই তুই করে কথা বলে না, বলতে পারে
সেটাও সে লক্ষ করল। উত্তর দেওয়ার আগে টুনি ভালো করে রাজুর মুখটা লক্ষ করল, সেটা কেমন যেন দুঃখী একজনের মুখ।
টুনি বলল, “অবশ্যই ঝগড়া করে। পৃথিবীর কোনো আব্বু-আম্মু নাই যারা মাঝে মাঝে ঝগড়া করে না। যদি দেখা যায় কোনো আব্বু-আম্মু ঝগড়া করছে। তাহলে বুঝতে হবে কোনো একটা বড় সমস্যা আছে।”
“কী সমস্যা?”
“মনে কর ওয়াইফ-হাজব্যান্ড থেকে বয়সে অনেক ছোট। অনেক ভয় পায় এরকম। তা না হলে যেকোনো হাজব্যান্ড-ওয়াইফ মাঝে মাঝে ঝগড়াঝাটি করে।”
“তোমার আব্বু আর আম্মু কীভাবে ঝগড়াঝাটি করে?”
টুনি মাথা চুলকাল, তারপর ইতস্তত করে বলল, “সেটা ঠিক জানি না। কোননাদিন আমাদের সামনে ঝগড়া করে নাই।”
রাজু ঝট করে মাথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তাহলে কেমন করে জান তোমার আব্বু-আম্মু ঝগড়া করে?”
“বোঝা যায়।” টুনি মুখে হাসি টেনে বলল, “দেখা যায় আব্বু-আম্মু কথা বলছে না। খাবার টেবিলে দুজনেই মুখ ভোঁতা করে বসে খাচ্ছে। কিংবা আম্মু খামাখো আমাদের ওপর মেজাজ করছে। কিংবা খারাপ খারাপ কথা বলছে–”
“খারাপ খারাপ কথা?” রাজু এবারে উৎসাহী হলো, জিজ্ঞেস করল, “কী রকম খারাপ খারাপ কথা?”
টুনি রীতিমতো ডায়ালগের মতো ভঙ্গি করে বলল, “যেরকম মনে কর আম্মুর ফেবারিট খারাপ কথা হচ্ছে–” টুনি তখন রীতিমতো নাটকের ডায়লগের মতো ভঙ্গি করে বলল “আমাকে তো পেয়েছিস একজন দাসী বান্দি? লাট সাহেবদের সেবা করতে করতে জান কালি করে ফেলতে হবে। এক গ্লাস পানি পর্যন্ত নিজেরা ঢেলে খেতে পারবে না! এইরকম।”
রাজু একটু অবাক হয়ে বলল, “এইটা সবচেয়ে খারাপ কথা?”
“এই রকমই তো হবে। আর কী হবে?”
“কখনো কখনো—” কিছু একটা বলতে গিয়ে রাজু থেমে গেল।
টুনি বলল, “বল। কী বলতে চাইছিলি বল।”
“বলছিলাম কী–” রাজু ইতস্তত করে বলল, “কখনো তোর আব্বু কী আম্মুর গায়ে হাত তুলে? কিংবা আম্মু—”
টুনি ভেতরে ভেতরে চমকে উঠল কিন্তু বাইরে সেটা প্রকাশ করল না। মুখ শান্ত করে বলল, “না সেরকম ঘটনা কখনোই ঘটে না। এটা খুব সিরিয়াস ঘটনা। এটা আসলে ঘটা উচিত না। কখনোই ঘটা উচিত না।” টুনি একটা নিঃশ্বাস ফেলল, তারপর বলল, “তোর আব্বু-আম্মুর বেলায় কী কখনো ঘটেছে?”
“কখনো? রাজু কেমন করে জানি একটা হাসির মতো করে শব্দ করল, তারপর বলল, “প্রত্যেকদিন ঘটে।”
“প্রত্যেকদিন?”
রাজু মাথা নাড়ল। বলল, “হ্যাঁ, প্রত্যেকদিন। দুজন অফিস থেকে এসে শুরু করে দেয়। খারাপ খারাপ ভাষায় একজন আরেকজনকে গালি দেয়। তারপর এক সময়ে দুজনেই ভাঙচুর করে। আম্মু মাঝে মাঝে গলা ফাটিয়ে কাঁদে।”
টুনি রাজুকে কথার মাঝখানে থামিয়ে বলল, “রাজু–”
“কী?”
“তোর আর বলার দরকার নেই। আমি বুঝতে পারছি।”
“তুমি মোটেই বুঝতে পারছ না। এর ভেতরে নিজে না থাকলে কেউ বুঝতে পারবে না। আমার মাঝে মাঝে কী মনে হয় জান?”
রাজু কী বলবে টুনি আন্দাজ করতে পারে, তারপরও জিজ্ঞেস করল, “কী?”
“মনে হয় ছয়তলা বাসার ছাদে উঠে নিচে লাফ দিই।”
টুনি অবাক হয়ে রাজুর দিকে তাকিয়ে রইল, তারপরে বলল, “খবরদার–রাজু হাসার মতো ভঙ্গি করে বলল, “ভয় নাই। লাফ দেব না।”
“গুড।” টুনিও হাসার মতো চেষ্টা করে বলল, “তুই যে আমাকে কথাগুলো বলেছিস সেজন্যে তোকে থ্যাংকু।”
“সবাই বলে তোমার মাথায় অনেক বুদ্ধি–”
টুনি মাথা নেড়ে বলল, “না না। আমার মাথায় মোটেও অনেক বুদ্ধি না। চৌবাচ্চার অঙ্কটা কীভাবে শুরু করব তার মাথা-মুণ্ড পর্যন্ত আন্দাজ করতে পারছি না। তুই যখন করবি তখন আমাকে বলিস।”
রাজু বলল, “লেখাপড়ার বুদ্ধি এক রকম আর আসল বুদ্ধি অন্যরকম। দুইটার মাঝে কোনো সম্পর্ক নাই।”
রাজু কিছুক্ষণ চুপ করে রইল তারপর বলল, “তোমার মাথায় তো অনেক বুদ্ধি, তুমি আমাকে বলবে আমি কী করব?”
টুনির রাজুর জন্যে খুব কষ্ট হলো। সে এখন তাকে কী বলবে? জিজ্ঞেস করল, “এখন তুই কী করিস?”
“কানে আঙুল দিয়ে ঘরে বসে থাকি। আগে জোর করে লেখাপড়া করতাম এখন আর লেখাপড়া করার ইচ্ছা করে না।”
টুনি বলল, “আমি আসলে তো কখনো এরকম অবস্থায় পড়ি নাই, এরকম কিছু দেখি নাই তাই ঠিক কী করতে হয় সেটা জানি না। তবে আমার মনে হয় তুই যেটা করছিস সেটা ঠিকই করছিস।”
“কী করছি?”
“এই যে আমাকে বলছিস।”
“বললে কী হয়?”
“আমি শুনেছি, মনে কষ্ট থাকলে সেটা নিয়ে আরেকজনের সাথে কথা বললে কষ্ট কমে।”
রাজু কিছু না বলে টুনির দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়ল। টুনি বলল, “শুধু একটা ব্যাপার।”
“কী ব্যাপার?”